বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাতে ড্রোন প্রযুক্তি আনতে চীনের সহায়তা চায়

বাংলাদেশ সরকার কৃষির আধুনিকীকরণে চীনের কাছ থেকে ড্রোন প্রযুক্তি আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে এবং কৃষক হবেন প্রযুক্তি নির্ভর।ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
কৃষি খাতে প্রযুক্তির নবদিগন্তে পা রাখছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের কৃষি খাত দীর্ঘদিন ধরে শ্রমনির্ভর ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদের গুরুত্ব অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে সময়, শ্রম ও খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার চীনের কাছ থেকে কৃষি খাতে ড্রোন প্রযুক্তি আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মাঠ পর্যায়ে ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, এবং কৃষি তথ্য বিশ্লেষণ অনেক সহজ ও কার্যকর হয়ে উঠবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করার জন্য প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করেই ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা তৈরি করছে।
চীনের সঙ্গে চুক্তির পথে বাংলাদেশ সরকার
সরকার ইতোমধ্যেই চীনের সঙ্গে কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা চালিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, একটি প্রাথমিক সমঝোতা স্মারক (MoU) প্রস্তুতের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে ড্রোন প্রযুক্তি আমদানি ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে। চীন যেহেতু বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ ড্রোন প্রস্তুতকারক ও কৃষি প্রযুক্তির রফতানিকারক, তাই তাদের কাছ থেকে কার্যকর প্রযুক্তি গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ। এই সহযোগিতা কেবল প্রযুক্তি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও কৃষি নীতিমালার উন্নয়নেও সহায়ক হবে।
ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থার রূপান্তর
ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চতা থেকে জমির চিত্র তুলে এনে ফসলের অবস্থা বিশ্লেষণ করা যাবে, যা আগাম রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত প্রতিকার গ্রহণে সহায়তা করবে। তাছাড়া, ড্রোনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে জমিতে সার, পানি ও কীটনাশক প্রয়োগ করে সময় ও খরচ দুটোই কমানো সম্ভব। এ ছাড়া ম্যানুয়াল পদ্ধতির তুলনায় ড্রোন অনেক বেশি নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারে, যা ফসলের গুণমান উন্নত করতে পারে। এই প্রক্রিয়া বিশেষ করে বড় আকারের কৃষি খামারে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হবে, যেখানে মেশিনের মাধ্যমে কাজ করা অধিক লাভজনক ও টেকসই।
প্রশিক্ষণ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা
ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার শুধু প্রযুক্তি আমদানির মাধ্যমে সম্ভব নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। সরকার এজন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও কৃষকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম করে তোলার জন্য আলাদা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কৃষকরা নিজেরাই জমিতে ড্রোন পরিচালনা করতে পারবেন, যা তৃতীয়পক্ষের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কৃষি ও প্রকৌশল বিভাগে ড্রোন প্রযুক্তি সংক্রান্ত কোর্স চালু করার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে, যাতে একটি প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিভিত্তিক কর্মশক্তি গড়ে ওঠে।

ছবিঃ ইনভেস্ট ইন চায়না
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষির সম্ভাবনা
ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, পানির অপচয় রোধ এবং নির্ধারিত মাত্রায় সার প্রয়োগের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। যান্ত্রিক এবং ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অধিক পরিমাণে সার প্রয়োগের ফলে যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়, তা ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। একই সঙ্গে জমির উর্বরতা বজায় রাখা এবং ফসলের গুণগতমান উন্নয়নের দিকেও এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সরকার এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘স্মার্ট এগ্রিকালচার’ ধারণার বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে চায়।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও স্থানীয় উৎপাদন
প্রাথমিকভাবে ড্রোন প্রযুক্তি আমদানির মাধ্যমে ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকলেও সরকার দীর্ঘমেয়াদে দেশীয়ভাবে ড্রোন তৈরির উদ্যোগও গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং নতুন উদ্যোক্তারা এই খাতে এগিয়ে আসার সুযোগ পাবেন। সরকারের লক্ষ্য, এই প্রযুক্তি ব্যবহারে একটি আত্মনির্ভরশীল কৃষি খাত গড়ে তোলা, যেখানে চীন বা অন্য দেশের উপর নির্ভরতা সীমিত থাকবে। তাছাড়া ড্রোন রক্ষণাবেক্ষণ, সফটওয়্যার আপডেট এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ক ব্যবসার ক্ষেত্রেও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন বাজার তৈরি হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত লক্ষ্য
বাংলাদেশ সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার যে রূপরেখা ঘোষণা করেছে, তার গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হিসেবে কৃষিকে ডিজিটাল ও প্রযুক্তিনির্ভর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ড্রোন প্রযুক্তির প্রয়োগ সেই পরিকল্পনার একটি বাস্তব রূপ। সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, কৃষিকে এমন একটি লাভজনক ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে গড়ে তোলা যেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক হবেন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, শুধু শ্রমজীবী নয়। ভবিষ্যতে ড্রোন ছাড়াও অন্যান্য প্রযুক্তির—যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রিমোট সেন্সিং, বিগ ডেটা ইত্যাদি—ব্যবহার করে বাংলাদেশের কৃষি খাতকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।