বাংলাদেশে সমঝোতা কমিশনের ব্যর্থতা: জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধা

বাংলাদেশে গঠিত সমঝোতা কমিশন বারবার আলোচনার পরও একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে। জানুন কেন ব্যর্থ হলো এই উদ্যোগ, কী বলছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এবং ভবিষ্যতের আশঙ্কা। ছবিঃ পিআইডি
সমঝোতা কমিশনের ব্যর্থতা: রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন মাত্রা
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে চরম মেরুকরণ ও মতপার্থক্য বিদ্যমান, তার প্রেক্ষিতে সমঝোতা কমিশনের গঠন অনেকের কাছে আশার আলো হিসেবে দেখা দিয়েছিল। কমিশনের মূল লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তোলা, যাতে আগামী নির্বাচনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর সব রাজনৈতিক পক্ষ একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে একাধিক বৈঠক ও আলোচনার পরও, এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে দেশের রাজনীতি আরও জটিলতার দিকে যাচ্ছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে যে সেতুবন্ধনের প্রয়োজন ছিল, এই কমিশনের ব্যর্থতা তা ভেঙে দিয়েছে।
কমিশনের উদ্দেশ্য ও প্রতিষ্ঠার পটভূমি
সমঝোতা কমিশন গঠিত হয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে, যার লক্ষ্য ছিল একটি বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য ভিত্তি তৈরি করা। এই কমিশনে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উভয় পক্ষের প্রতিনিধি থাকায় অনেকে আশা করেছিলেন, এটি একটি কার্যকর সংলাপের মঞ্চ হিসেবে কাজ করবে। তবে প্রাথমিক কৌশলগত পরিকল্পনা এবং কমিশনের গঠনপ্রণালী নিয়েই দলগুলোর মধ্যে বিভাজন শুরু হয়। কেউ কেউ অভিযোগ করেন যে, এই কমিশন কার্যত সরকারপন্থী এবং বিরোধীদের মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ফলে শুরু থেকেই কমিশনের কার্যক্রম ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
আলোচনায় অচলাবস্থা ও মতানৈক্যের বিস্তার
কমিশনের প্রতিটি বৈঠকে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একমত হতে পারছে না। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন, সেনা মোতায়েন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রবল মতবিরোধ দেখা দেয়। কোনো পক্ষই নিজেদের অবস্থান থেকে একচুলও সরতে রাজি হয়নি, যার ফলে আলোচনা অচল অবস্থায় পড়ে যায়। শুধু তাই নয়, পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের প্রবণতা এতটাই বেড়েছে যে, বাস্তবসম্মত সমঝোতার জায়গা দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমনকি কিছু বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে।
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া ও হতাশা
কমিশনের কার্যক্রমে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, তারা সবদিক থেকে নমনীয়তা দেখিয়েছে এবং জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা বিরোধীদের অস্বচ্ছ মনোভাব এবং অযৌক্তিক দাবি দায়ী করেছে এই ব্যর্থতার জন্য। অন্যদিকে, বিরোধীদলীয় নেতারা একে প্রহসন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, এই কমিশন সরকারের একটি নাটকীয় প্রয়াস, যার মূল লক্ষ্য ছিল সময়ক্ষেপণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা। ফলে কমিশনের ব্যর্থতা রাজনীতিতে গভীর হতাশা ও বিভক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

ছবিঃ এনডিটিভি
জাতীয় সংলাপের আশায় ভাটা
কমিশনের ব্যর্থতার ফলে জাতীয় সংলাপের আশায় বড় ধাক্কা লেগেছে। যেহেতু কমিশনই ছিল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সংলাপের একমাত্র প্ল্যাটফর্ম, এর ব্যর্থতায় অনেকেই মনে করছেন, ভবিষ্যতে আর কোনও কার্যকর সংলাপ সম্ভব হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার চরম অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় কোনও কমিশন বা সংলাপ ফলপ্রসূ হওয়া প্রায় অসম্ভব। সাধারণ জনগণও এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন, কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সরাসরি দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সতর্কবার্তা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সমঝোতা কমিশনের ব্যর্থতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গভীর সমস্যার প্রতিফলন। দলীয় স্বার্থ, ক্ষমতার লড়াই এবং ব্যক্তিগত এজেন্ডা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক ধারাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি রাজনৈতিক নেতারা আত্মসমালোচনা না করেন এবং সম্মিলিত উদ্যোগ না নেন, তবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও প্রকট হতে পারে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দৃশ্যপট ও জনগণের করণীয়
এই ব্যর্থতার ফলে আগামী নির্বাচনে সংঘর্ষ, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো আবারও কোনও বৈধ সমাধানে না পৌঁছায়, তাহলে নির্বাচনকালীন সময়টি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। দেশের জনগণ একদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভুগছে, অন্যদিকে তারা কার্যকর নেতৃত্বের প্রত্যাশায় আছে। রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সমঝোতার জন্য কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, বরং জনগণের পক্ষ থেকেও চাপ তৈরি করা জরুরি।