অবৈধ অর্থপাচার থেকে উদ্ধারকৃত টাকায় সুবিধাভোগী হবে ব্যাংক ও অসহায় মানুষ

অবৈধ অর্থপাচার

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, অবৈধ অর্থপাচার রোধে উদ্ধার হওয়া অর্থের একটি অংশ ব্যাংক খাতের উন্নয়ন ও অসহায় জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন। ছবিঃ প্রথম আলো

অর্থপাচারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় জানিয়েছেন যে, দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অর্থপাচারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক মারাত্মক হুমকি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ট্রানজেকশন মনিটরিং, সন্দেহজনক লেনদেন যাচাই ও অর্থনৈতিক গোয়েন্দা ইউনিটের শক্তিশালীকরণ। এই জিরো টলারেন্স নীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে, অবৈধ অর্থপাচার বন্ধ করে দেশের অর্থ সম্পদ দেশের মধ্যেই ধরে রাখা।

অর্থ উদ্ধার নিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি

গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একাধিক আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকার অবস্থান শনাক্ত করে তা ফেরত আনার কাজ শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে সম্প্রতি বহু কোটি টাকা বিদেশ থেকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। এসব উদ্ধারকৃত অর্থ এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এর ব্যবহারের বিষয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এই অগ্রগতি কেবল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই নিশ্চিত করছে না, বরং জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা বাড়াচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নে অর্থের ব্যবহার

গভর্নর বলেন, অর্থপাচার থেকে ফেরত আনা অর্থের একটি বড় অংশ ব্যাংকিং খাতে পুনঃবিনিয়োগ করা হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা কাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল সিকিউরিটি বাড়ানো, এবং গ্রাহকসেবার মান উন্নয়নের দিকেই এই অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা ও অদক্ষতা দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান, যেগুলোর সমাধানে এই অর্থ খুবই কার্যকর হতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো যাতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পরিচালিত হয়, সেই লক্ষ্যে আইটি অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নেও এই অর্থ ব্যবহার হবে।

অসহায় জনগণের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, যে অর্থ রাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায় জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। তিনি উল্লেখ করেন, গ্রামীণ দরিদ্র পরিবার, হতদরিদ্র নারী, প্রতিবন্ধী এবং অনাথ শিশুদের জন্য বিশেষ কল্যাণ কর্মসূচি গৃহীত হবে। এর মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই অর্থ ব্যবহারে একটি স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামো তৈরি করা হবে যাতে জনগণ প্রকৃত অর্থে এর সুফল পায়।

অর্থ উদ্ধার

ছবিঃ নিউ এইজ

অর্থপাচার প্রতিরোধে আইনি সংস্কার

গভর্নর বলেন, অবৈধ অর্থপাচার বন্ধে আইনগত কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে একাধিক সংস্কার আনা হয়েছে। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও, অর্থপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও প্রস্তাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে কাজ করা ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) এখন আরও বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করছে এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ অর্থ লেনদেনের উপর নজরদারি করছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া অর্থপাচার প্রতিরোধ সম্ভব নয় বলেও মত প্রকাশ করেন গভর্নর। তিনি জানান, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তথ্য বিনিময় চুক্তি করেছে। এর ফলে বিদেশে লুকিয়ে রাখা টাকার অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছে এবং অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া সহজ হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের সমঝোতা চুক্তির সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে, যাতে করে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখা হলেও তা শনাক্ত করে ফেরত আনা যায়।

সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি

গভর্নরের মতে, অর্থপাচার রোধে কেবল আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, সাধারণ জনগণের সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি। তিনি বলেন, কর ফাঁকি, হুন্ডি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে লেনদেনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে হবে। তাই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক একযোগে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে। এই উদ্যোগে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং কমিউনিটি পর্যায়ে আলোচনাসভা, পোস্টার ক্যাম্পেইন এবং মিডিয়া প্রচারণা চালানো হবে যাতে করে তরুণ সমাজসহ সবাই বৈধ পথে অর্থ লেনদেন করতে উৎসাহিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *