অর্থ উপদেষ্টার বাজেট ব্যাখ্যা: ‘শব্দের ফুলঝুরি দিয়ে বাজেট করিনি’

বাজেট বক্তব্য

অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, এবারের বাজেট বাস্তবমুখী ও গাণিতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। বিস্তারিত জানুন তার ব্যাখ্যা ও বাজেট পরিকল্পনার মূল দিকগুলো। ছবিঃ প্রথম আলো

বাস্তবতার ভিত্তিতে বাজেট তৈরির দাবি অর্থ উপদেষ্টার

চলমান অর্থনৈতিক চাপ, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে অর্থ উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেছেন, এবারের বাজেট কেবল শব্দের বাহার নয়, বরং একটি সুসংহত, সুপরিকল্পিত এবং তথ্যভিত্তিক প্রস্তাব। তিনি বলেন, বাজেট তৈরির প্রতিটি ধাপে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা, রাজস্ব আহরণের সম্ভাবনা এবং ব্যয়ের যৌক্তিকতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই বাজেট কেবল একটি কাগজে ছাপানো সংখ্যার খেলা নয়, বরং এটি দেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করার একটি বাস্তব রূপরেখা। অর্থ উপদেষ্টার এমন স্পষ্ট বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার নেতৃত্বে যে টিম কাজ করেছে তারা যথেষ্ট দায়িত্বশীলতা ও বাস্তব জ্ঞান নিয়ে কাজ করেছে।

জনসাধারণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে গৃহীত হয়েছে সিদ্ধান্ত

অর্থ উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, এবারের বাজেট সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে এমন খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, শিক্ষা খাতে ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ, স্বাস্থ্যসেবা প্রসারে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় বরাদ্দ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ এই বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি জানান, প্রতিটি খাতেই চেষ্টা করা হয়েছে এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যা শুধু শহর নয়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকেও উপকৃত করবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো এবং উন্নয়নের সুফল সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বাজেটের কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে।

ব্যয় ও রাজস্ব আয়ের ভারসাম্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব

অর্থ উপদেষ্টা জানান, রাজস্ব ও ব্যয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট তৈরিতে যেখানে ব্যয়ের চাহিদা ছিল অনেক বেশি, সেখানে সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ ব্যয় করা যায়, সেটিই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। রাজস্ব আহরণে এনবিআরের সংস্কার, নতুন করজালের আওতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা চালু করার মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানোর রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যয় খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে প্রয়োজনীয় খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

বিদেশি ঋণ নির্ভরতা হ্রাসে সরকার সচেষ্ট

দেশীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরতা কমানোর দিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, অতীতের তুলনায় এবার উন্নয়ন বাজেটের বড় একটি অংশ স্থানীয় উৎস থেকে যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাজেট বাস্তবায়নের সময়ে বৈদেশিক চাপ কমবে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাবে। অর্থ উপদেষ্টা আরো বলেন, শুধু বিদেশি অনুদান ও ঋণের ওপর নির্ভর করলে স্থায়িত্ব আসে না, বরং নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। এই নীতিমালার ভিত্তিতেই বাজেট গঠন করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনা

ছবিঃ সংগ্রহ

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, অর্থনৈতিক বাস্তবতাই ছিল কেন্দ্রবিন্দু

বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেন, এবারের বাজেট কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তিনি বলেন, বাজেট এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব হয়। এটি কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণির মানুষকে উপকারে আনবে এমনভাবে পরিকল্পিত। উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাছাই, রফতানিমুখী শিল্পে প্রণোদনা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা বাজেটের এমন কিছু দিক যা রাজনৈতিক নয়, আর্থিক বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত।

তরুণ সমাজের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত

বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মক্ষম করে তোলা অপরিহার্য। সেই লক্ষ্যে এবারের বাজেটে তরুণ সমাজকে কেন্দ্র করে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে নতুন বরাদ্দ, আইটি ও স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ, উদ্ভাবনী প্রকল্পে সহায়তা এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা—এই সবই তরুণদের আর্থিক ও পেশাগত উন্নয়নে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি উল্লেখ করেন, “তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করলে অর্থনীতির গতি স্থবির হয়ে পড়বে, তাই তাদের এগিয়ে নিতে বাজেটই হতে পারে প্রধান হাতিয়ার।

বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে সরকার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তিনি জানান, প্রতিটি খাতের ব্যয় পর্যালোচনার জন্য একটি ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি মনিটরিং করা যাবে। একইসঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আরও সক্রিয় করা হবে। তার ভাষায়, “প্রতিটি টাকার পেছনে জবাবদিহি থাকতে হবে, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি।” এই অবস্থান বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

বাজেট ব্যাখ্যার পর জনমনে প্রতিক্রিয়া

অর্থ উপদেষ্টার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণের পর বাজেট নিয়ে জনমনে একটি ভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মনে করছেন, বাজেট এখন আর শুধুমাত্র পরিসংখ্যান বা ভাষার প্রদর্শনী নয়, বরং এটি একটি পরিকল্পিত এবং জনমুখী দিকনির্দেশনা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটের মূল শক্তি হচ্ছে এর বাস্তবমুখিতা এবং যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করবে। যদিও চূড়ান্ত বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করবে বাজেটের সফলতা, তবে অর্থ উপদেষ্টার এই ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *