খেলোয়াড়দের দোটানা ও ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ সংকট

জাতীয় দলের ডাক ও আইপিএলের আর্থিক সুবিধার মাঝে দ্বন্দ্বে পড়েছেন ক্রিকেটাররা। সূচির সংঘাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তৈরি হয়েছে নতুন ধাক্কা। ছবিঃ এএফপি
আইপিএল বনাম জাতীয় দল: খেলোয়াড়দের এক দোটানার গল্প
বর্তমান সময়ের পেশাদার ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত একটি ইস্যু হয়ে উঠেছে খেলোয়াড়দের জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব এবং আইপিএলের মতো উচ্চ বেতনের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের মধ্যে দ্বন্দ্ব। জাতীয় দলের হয়ে খেলা দীর্ঘদিন ধরে গর্বের বিষয় হলেও, আইপিএল খেলোয়াড়দের সামনে এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, খ্যাতি এবং পেশাগত স্থায়িত্বের এক অনন্য সুযোগ। এই দুই দিক একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে এখন অনেক খেলোয়াড় পড়ছেন বিপদে, যা কেবল তাদের ব্যক্তিগত নয়, গোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ব্যবস্থার সামগ্রিক ভারসাম্যকেই হুমকির মুখে ফেলছে।
২০২৫ সালের আইপিএল যেমন একটি দীর্ঘ ও বর্ধিত সংস্করণে রূপ নিয়েছে, তেমনি অনেক জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক সূচি একই সময়ে চলমান। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশের মত শীর্ষ দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ খেলছে এই সময়ে, যার কারণে অনেক শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়কে একসঙ্গে দুই জায়গায় উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। এটা শুধু শারীরিক ক্লান্তির নয়, মানসিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হবারও অন্যতম কারণ। ফলে বোর্ড, খেলোয়াড় এবং সমর্থক—তিন পক্ষই এই সূচির সংঘাতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
খেলোয়াড়দের মানসিক দ্বন্দ্ব: কার ডাকে সাড়া দেবেন তারা?
একজন ক্রিকেটারের জন্য দেশের হয়ে খেলা মানে আত্মপরিচয়, ভক্তদের ভালোবাসা ও জাতীয় গর্ব। কিন্তু আধুনিক ক্রিকেটের বাস্তবতা হলো—বাণিজ্যিক লিগগুলোর উপস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে খেলোয়াড়েরা দেশের হয়ে খেলার সুযোগ ছেড়ে আইপিএলকে বেছে নিচ্ছেন। আইপিএলের চুক্তি শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং ক্যারিয়ারের ধারাবাহিক উন্নতির একটি প্ল্যাটফর্মও। এর ফলে, একজন খেলোয়াড় নিজের দেশ ও নিজের ভবিষ্যতের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে মানসিক চাপে পড়ে যাচ্ছেন, যা তার পারফরম্যান্সেও প্রভাব ফেলতে পারে।
বোর্ডগুলোর অস্পষ্ট অবস্থান: খেলোয়াড়রাও পাচ্ছেন না নির্দেশনা
জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডগুলোর অনেকেই তাদের খেলোয়াড়দের আইপিএলে খেলার অনুমতি দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ বাধা দিচ্ছে। কিন্তু সব বোর্ডেই একটি অভিন্ন সমস্যা—একটি স্থির নীতি না থাকা। কেউ কেউ খেলোয়াড়দের ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিচ্ছে, কেউ আবার আইপিএল-পূর্ব প্রস্তুতি ক্যাম্পে যোগ দিতে বাধ্য করছে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ অবস্থান শুধু খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত করছে না, বরং ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেও অনিশ্চিত করে তুলছে। বিসিসিআই যেহেতু আইপিএলের আয়োজক ও সবচেয়ে শক্তিশালী বোর্ড, তাদের ভূমিকা এই দ্বন্দ্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা দৃশ্যমান নয়।

ছবিঃ ইওয়াল
আইসিসির নীরবতা এবং বিশ্ব ক্রিকেটের ঝুঁকি
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (ICC) এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সূচির সংঘাত মোকাবেলায় তারা একটি ‘গ্লোবাল ক্যালেন্ডার’ প্রস্তাব করলেও সেটি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এমনকি অনেক সময় জাতীয় দলের ম্যাচও আইপিএলের কারণে স্থগিত হচ্ছে বা দুর্বল স্কোয়াড নিয়ে খেলতে হচ্ছে, যা ক্রিকেটের মান এবং প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করছে। আইসিসির এই নির্লিপ্ত ভূমিকায় ক্রিকেট ভক্তরা হতাশ, এবং এই ধারা চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গুরুত্ব ভবিষ্যতে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জাতীয়তা বনাম প্রফেশনালিজম: ভবিষ্যতের ক্রিকেট কোন পথে?
একদিকে আবেগ, অন্যদিকে বাস্তবতা—এই দুইয়ের টানাপোড়েন আজ ক্রিকেটারদের নিয়মিত সঙ্গী। জাতীয় দলের হয়ে খেলা মানে নিজের পতাকার প্রতি সম্মান, কিন্তু পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ একটি নির্ভরযোগ্য ক্যারিয়ার ট্র্যাক। ক্রিকেট ধীরে ধীরে যদি শুধুই অর্থ ও চুক্তির খেলা হয়ে যায়, তবে জাতীয় দলের গৌরব হারিয়ে যেতে পারে, আর সেটি ক্রিকেটের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে তুলবে। ভবিষ্যতের ক্রিকেট যেন শুধুই লিগভিত্তিক না হয়ে পড়ে, সেই চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করতে হবে।
সমাধানের পথ: বোর্ড ও আইসিসির যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন
এই সংকট নিরসনের জন্য প্রয়োজন বোর্ডগুলোর মধ্যে আন্তঃবোর্ড সমন্বয়, খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার পরিকল্পনার স্বচ্ছতা এবং আইসিসির একটি ঐক্যবদ্ধ ও প্রভাবশালী নীতি। একটি ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি উইন্ডো’ তৈরির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সূচির সঙ্গে আইপিএলকে সমন্বিত করা যেতে পারে। খেলোয়াড়দের উচিত হবে ক্লিয়ার গাইডলাইন পাওয়া এবং দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে খেলার সুযোগ সৃষ্টি করা। এটি শুধু তাদের জন্যই নয়, গোটা ক্রিকেট বিশ্বের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতাকে নিশ্চিত করবে।