আগস্ট ২১ গ্রেনেড হামলা: সুপ্রিম কোর্টে কাল থেকে পুনরায় শুনানি শুরু

২০০৪ সালের আগস্ট ২১ গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল শুনানি সুপ্রিম কোর্টে আগামীকাল থেকে পুনরায় শুরু হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়াবহ এই হামলার বিচার নিয়ে নতুন করে আশাবাদী আইনজীবী ও নাগরিক সমাজ। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
আগস্ট ২১ গ্রেনেড হামলা: বিচার প্রক্রিয়ায় নতুন অগ্রগতি, সুপ্রিম কোর্টে কাল শুনানি
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। সেদিন রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের একটি সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা, যিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেড বিস্ফোরণে দলের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং আরও কয়েক শতাধিক আহত হন। দীর্ঘ বছর পর, সেই হামলার বিচারিক কার্যক্রম এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করেছে। আগামীকাল থেকে সুপ্রিম কোর্টে পুনরায় মামলার আপিল শুনানি শুরু হচ্ছে, যা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
১৯ বছরের বেশি সময় পর বিচারিক অগ্রগতি: আদালতের দিকে তাকিয়ে দেশ
এ ঘটনার পর তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রম নানা সময় বাধাগ্রস্ত হয়েছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক জটিলতা মামলাটির অগ্রগতি ধীর করে দেয়। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মামলার পুনঃতদন্তের উদ্যোগ নেয় এবং ২০১৮ সালে নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণা করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়, হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং এর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল স্পষ্ট। রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করে এবং রাষ্ট্রপক্ষ থেকে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কার্যকর চেয়ে আপিল দায়ের করে, যার শুনানি শুরু হচ্ছে কাল থেকে সুপ্রিম কোর্টে।
হামলার ভয়াবহতা ও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য: একটি জাতির ক্ষতচিহ্ন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে যে, তাঁরা হামলাটি পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড, হামলাকারীদের নিরাপদে প্রস্থান, তদন্তে অসংগতির পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের উপর মামলা দায়ের—সব কিছু মিলিয়ে এটি ছিল একটি ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় জটিলতা। জাতি এই ঘটনার বিচার চায় ন্যায়ের স্বার্থে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশোধ নয় বরং ভবিষ্যতে এ ধরণের হামলা প্রতিরোধে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে।
মামলার আসামিরা কারা: রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগ
নিম্ন আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, বিএনপি নেতা তারেক রহমান (পলাতক), এবং দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কিছু সদস্য। এ ছাড়া হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ জঙ্গি সংগঠনের অনেক নেতা গ্রেপ্তার হন ও দণ্ডপ্রাপ্ত হন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরের অনেকেই এই হামলায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার ফলে এটি শুধু জঙ্গিবাদী হামলা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত এক জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ছবিঃ বিএসএস
সুপ্রিম কোর্টে শুনানি নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রস্তুতি: ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইনজীবীদের একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছেন যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুনানি শেষ করা যায় এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। মামলার নথিপত্র, সাক্ষীর বিবরণ, তদন্ত প্রতিবেদন ও প্রমাণাদি সুপ্রিম কোর্টে যথাযথভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে রায়ের আইনি ভিত্তি দৃঢ় করা হবে। দেশের সাধারণ মানুষও বিচারিক প্রক্রিয়ার গতি দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
আসামিপক্ষ শুরু থেকেই দাবি করে আসছে যে, এ মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদের আইনজীবীরা বলছেন, মামলায় প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত হয়নি বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য তদন্ত পরিচালিত হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিতর্ক রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে তারা রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরবেন এবং আদালতের নিকট ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করবেন বলে জানা গেছে। তবে মামলাটি যেহেতু অতীতের বহু তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্যনির্ভর, তাই আদালত নিরপেক্ষভাবে সব কিছু পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দেবে।
আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ও মিডিয়ার নজর
এত আলোচিত মামলার শুনানি হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে যাতে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটে। আদালতের প্রবেশপথে নিরাপত্তা চেক, মিডিয়া প্রতিনিধিদের পরিচয় যাচাই ও নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ, এমনকি ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। গণমাধ্যমের ক্যামেরা ও প্রতিবেদকেরা দিনভর আদালতের সামনে উপস্থিত থাকবেন, কারণ পুরো দেশ তাকিয়ে আছে এই মামলার পরবর্তী অগ্রগতির দিকে।