আধিপত্য পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব: বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার নতুন ধারা

আধিপত্য পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে কীভাবে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বাড়ছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও সামরিক প্রস্তুতির দিক বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ছবিঃ প্রথম আলো ইংলিশ
আধিপত্য পরিবর্তনের ফলে সংঘাতের সূচনা
বিশ্ব ইতিহাসে আধিপত্যের পরিবর্তন বা শক্তির পালাবদল সবসময়ই বড় ধরণের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। একসময়ের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র – প্রতিবার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন সংঘাত, যুদ্ধ এবং ক্ষমতার নতুন ভারসাম্য। বর্তমানে আমরা একটি নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে চীন, রাশিয়া, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশগুলোর উত্থান বিশ্বব্যবস্থার দীর্ঘদিনের প্রচলিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে অন্যান্য দেশগুলো নিজেদের অবস্থানকে জোরালো করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই পালাবদলের প্রক্রিয়াই সৃষ্টি করছে সংঘাত ও অস্থিরতা।
ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
বিশ্ব রাজনীতির মাঠে শক্তির ভারসাম্য নড়বড়ে হলে সবচেয়ে আগে দেখা দেয় কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের সাথে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, এবং NATO’র সম্প্রসারণ এসবই আধিপত্য পুনঃবন্টনের অংশ। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যেও ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চলমান প্রতিযোগিতা ঘনীভূত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতাগুলো অনেক সময় সরাসরি যুদ্ধে রূপ নেয়, আবার কখনো তা ঘটে প্রক্সি যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে ভূরাজনীতি হয়ে উঠছে এক উত্তপ্ত ক্ষেত্র, যেখানে প্রতিটি পা ফেলতেই রাষ্ট্রগুলোর কৌশলী হতে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক আধিপত্যের পরিবর্তন ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
অর্থনৈতিকভাবে আধিপত্য পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে চীনের উত্থান এবং ব্রিকস (BRICS) জোটের সম্প্রসারণ। যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান বা বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের প্রচেষ্টা ক্রমেই বাড়ছে। রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে ডলার নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন ভারসাম্য তৈরি হয়। এই অর্থনৈতিক শক্তি স্থানান্তরের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দুনিয়া অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং বাণিজ্যিক প্রভাব ধরে রাখার নতুন কৌশল নিচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা, যা বিশ্বব্যাপী সাধারণ জনগণের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থনৈতিক আধিপত্যের এই দ্বন্দ্বই অনেক ক্ষেত্রে সামরিক উত্তেজনার ভিত্তি গড়ে তুলছে।
সামরিক শক্তির পুনর্বিন্যাস এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা
আধিপত্যের দখল কেবল অর্থনীতি বা কূটনীতি দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে সামরিক প্রস্তুতির মাধ্যমে। NATO এবং AUKUS-এর মতো সামরিক জোটগুলোর সম্প্রসারণ এবং প্রতিক্রিয়ায় চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা – সবই একটি সম্ভাব্য নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করছে। মহাকাশে অস্ত্র স্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ড্রোন, এবং পরমাণু অস্ত্রের আধুনিকীকরণ – এই প্রতিযোগিতা বিশ্বকে আরেকটি অস্থিরতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যেকোনো সময় সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থেকেই শুরু হতে পারে বড় ধরণের সংঘাত, যার পরিণতি হয়তো বহু দেশকেই ভুগতে হবে। এই সামরিক প্রস্তুতির প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।