আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের পেছনের গোপন কারণ উন্মোচন

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকায় সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। তবে এর পেছনে রয়েছে জটিল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এল নিনো ও লা নিনার পালাবদল, এবং অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত। ছবি: সংগ্রহ
২০২৪ বনাম ২০২৫: এপ্রিলের গরমে আকাশ-পাতাল পার্থক্য
২০২৪ সালের এপ্রিল মাস বাংলাদেশে ছিল এক কথায় ভয়ঙ্কর। সারাদেশজুড়ে বিরাজ করেছিল তীব্র তাপপ্রবাহ, যার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছিল বিপর্যস্ত। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, রাজশাহীসহ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে দিনের পর দিন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ছিল। ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছিল, যা গত ৭৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শুধু তাই নয়, ওই সময়ে গরমের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। অসংখ্য মানুষ হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতা এবং নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। অনেক জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও পানির সংকট দেখা দেয়। অথচ, ২০২৫ সালের এপ্রিল ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩.৮ ডিগ্রি, যা তুলনামূলকভাবে সহনীয় এবং জনজীবন ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক।
আবহাওয়ার পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: এল নিনো ও লা নিনা
আবহাওয়াবিদদের মতে, ২০২৪ সালের তীব্র তাপপ্রবাহের জন্য মূলত দায়ী ছিল ‘এল নিনো’ নামক একটি জলবায়ু ঘটনার প্রভাব। এটি মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগের গরম জলমণ্ডলীয় স্রোতের পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট একধরনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে এল নিনোর প্রভাবে তাপপ্রবাহ বেড়ে যায় এবং বৃষ্টিপাতের হার কমে যায়।
২০২৫ সালের শুরু থেকেই ‘লা নিনা’ সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা এল নিনোর বিপরীত প্রভাব সৃষ্টি করে। এটি বৃষ্টিপাত বাড়ায় এবং আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা রাখে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এবারের এপ্রিল মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২০-২৫% বেশি, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডা আবহাওয়া বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। এমনকি রাতে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির কাছাকাছি নেমে আসার ঘটনাও ঘটেছে, যা এপ্রিলের জন্য অত্যন্ত বিরল।

ছবি: বিসনেস স্টান্ডের
কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কেমন ছিল এই এপ্রিল?
২০২৪ সালে তীব্র গরমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে কৃষিজীবী মানুষ। মাঠে কাজ করা কৃষক, রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিকদের জীবনে যেন নেমে এসেছিল অগ্নিপরীক্ষা। চুয়াডাঙ্গার হাজরাহাটির কৃষক রতন আলী বলেন, “মাঠে নামলে শরীরটা যেন আগুনে ঝলসে যায়, তবুও পেটের তাগিদে নামতে হয়।” গরমের কারণে ধানের ফলন কমে গিয়েছিল, বহু জমিতে চারা পুড়ে যায় এবং কৃষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
২০২৫ সালের তুলনামূলক ঠান্ডা এপ্রিল মাস অনেকটাই স্বস্তিদায়ক ছিল তাদের জন্য। তারা স্বাভাবিক সময়ে চাষাবাদ করতে পেরেছেন, ফলনও ছিল আশাব্যঞ্জক। তবে জলবায়ুর এমন আচরণবিধি তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। কারণ, এখন আর মৌসুমি আবহাওয়া নির্ভরযোগ্য নয় — আজ বৃষ্টি, কাল ঝড়, পরশু রোদ, যা কৃষির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
আগামী দিনের জন্য সতর্কতা ও করণীয়
বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের সমস্যা নয় — এটি বর্তমানে রূপ নিচ্ছে বাস্তব সংকটে। বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতি বছরই নানা ধরনের চরম আবহাওয়ার শিকার হচ্ছে। অতিরিক্ত গরম, অকাল বৃষ্টি, দীর্ঘ খরা বা আকস্মিক বন্যা — এসবের কারণে জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, তাপপ্রবাহ প্রতিরোধে শহরে সবুজায়ন, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সরকারকেও দুর্যোগ-প্রস্তুতি কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে হবে।