ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের চাষ ও বিক্রিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের চাষ ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, এসব গাছ পরিবেশ ও কৃষির জন্য ক্ষতিকর। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় গাছ চাষে নিষেধাজ্ঞা
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের চাষ, উৎপাদন ও বাণিজ্যিক বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই গাছগুলোর অতিরিক্ত চাষের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে একাধিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে। জানা গেছে, এই গাছগুলো মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, পানি শোষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি এবং অন্য গাছের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে, এগুলো পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ নয় বরং পরিবেশ ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সরকার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই বনায়ন নিশ্চিত করতে চায়।
ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির ক্ষতিকর প্রভাব
প্রথম দেখায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ আকর্ষণীয় ও দ্রুত বর্ধনশীল মনে হলেও, এগুলোর পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। ইউক্যালিপটাস গাছ শিকড় দিয়ে মাটির গভীর থেকে বিপুল পরিমাণ পানি শোষণ করে, যার ফলে আশেপাশের এলাকায় পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যায়। এতে কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংকট দেখা দেয়। অপরদিকে, আকাশমণি গাছ একটি ‘আলেলোপ্যাথিক’ প্রজাতি, যার অর্থ এর নিচে অন্যান্য উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না। এর ফলে প্রাকৃতিক গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়ে। এসব গাছ জমির গঠন পরিবর্তন করে, ফলে দীর্ঘমেয়াদে ভূমির উর্বরতা কমে যায় এবং কৃষির ক্ষতি হয়। এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলো বিবেচনা করেই সরকার গাছ দুটি নিষিদ্ধ করেছে।
কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি
এই গাছগুলো শুধু পরিবেশ নয়, দেশের কৃষি ব্যবস্থার জন্যও বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের বহু কৃষক কাঠ বিক্রির আশায় তাদের জমিতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি চাষ করছেন, কিন্তু তারা জানেন না যে দীর্ঘমেয়াদে এটি তাদেরই ক্ষতি ডেকে আনছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় পরবর্তী মৌসুমে ফসল উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাছাড়া, এসব গাছের কারণে পাখি, মৌমাছি ও অন্যান্য উপকারী প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রে ব্যাঘাত ঘটছে। বনজ সম্পদ যেমন ফলদ, ঔষধি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পরিবেশ ও কৃষিকে সুরক্ষিত রাখতে এসব গাছের বিস্তার এখনই রোধ না করলে ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

ছবিঃ পেপার মার্ট
সরকারের নির্দেশনা ও বিকল্প গাছের প্রস্তাব
পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার কেবল নিষেধাজ্ঞা জারি করেই থেমে থাকছে না, বরং এর বিকল্প হিসেবেও একটি ইতিবাচক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে সমন্বয় করে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ যেসব এলাকায় ব্যাপক হারে চাষ হয়েছে, সেগুলো শনাক্ত করে ধীরে ধীরে সেগুলো অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকার নাগরিকদের বিকল্প পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ যেমন মেহগনি, অর্জুন, নিম, বেলজিয়াম ও হরিতকী গাছ লাগাতে উৎসাহিত করছে। এই গাছগুলো শুধু পরিবেশের জন্য উপকারী নয়, বরং আর্থিক দিক থেকেও লাভজনক। আগামীতে যেকোনো বনায়ন প্রকল্প বা সামাজিক বনায়নে সরকার এই প্রজাতির গাছকে অগ্রাধিকার দেবে বলে জানা গেছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনি পদক্ষেপ
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সরকার নানা প্রচারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করছে, যাতে সাধারণ মানুষ এবং কৃষকরা সচেতন হন। টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচারণা, স্থানীয় প্রশাসনের সভা ও কৃষি মেলার মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে। সরকার বলেছে, কেউ যদি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইউক্যালিপটাস বা আকাশমণি গাছ চাষ বা বিক্রয় করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই পদক্ষেপ শুধু পরিবেশ রক্ষায় নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ও টেকসই প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার দিকে একটি অগ্রগামী পদক্ষেপ।