ইলিশ সংকটে জেলেদের করুণ অবস্থা, ভিজিএফ সহায়তার জোর দাবি

ইলিশ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় নদীপাড়ের হাজারো জেলে পড়েছেন চরম দুর্দশায়। তারা সরকারের কাছে জরুরি ভিত্তিতে ভিজিএফ সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন। জানুন বিস্তারিত। ছবিঃ টিটু দাস
ইলিশ মাছের সংকটে নদীপাড়ের জীবন বিপর্যস্ত
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইলিশ মাছ শুধু খাদ্য উপাদান নয়, এটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও নদীপাড়ের জীবনধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবছর বর্ষাকালে যখন ইলিশ মৌসুম শুরু হয়, তখন হাজার হাজার জেলে নৌকা নিয়ে নদীতে নামেন আশায়—আজ ভালো মাছ পাবেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে সেই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকাংশ জেলেই এখন খালি হাতে ফিরে আসছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে কাটালেও তেমন কোনো মাছ ধরা পড়ছে না। ইলিশ মাছের কম উৎপাদন জেলেদের জীবিকা সংকটের মুখে ফেলেছে, এবং তাদের পরিবারগুলো পড়েছে খাদ্যাভাবের তীব্র চাপে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন ইলিশ উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগর ও নদীর পানির তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়েছে, যা ইলিশের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। সেই সঙ্গে নদীর নাব্যতা হ্রাস, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, পানি দূষণ এবং অবাধ জাল ফেলা ইলিশ মাছের সংখ্যাকে বিপদে ফেলছে। এছাড়া, প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইলিশের অভিবাসন ও বংশবৃদ্ধির ধারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলোতে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, যা শুধু জেলেদের জন্য নয়, দেশের মাছ বাজার ও রপ্তানি ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জেলেদের সহায়তা প্রয়োজন, বাস্তবে ভিজিএফ পাচ্ছেন অল্পই
যদিও সরকার বছরে কয়েকবার মৎস্যজীবীদের সহায়তা হিসেবে ভিজিএফ চালু করে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য এবং সীমিতসংখ্যক লোকের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অনেক জেলে অভিযোগ করছেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বরং এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। একাধিক এলাকায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাব বা দুর্নীতির কারণে ভিজিএফ কার্ড এমন ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে যারা প্রকৃত অর্থে জেলে নন। ফলে নদীপাড়ে যেসব পরিবার দিনে দিনে খাদ্যসংকটে ভুগছে, তাদের আর্থিক টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
মাছ না পাওয়ায় ঋণে ডুবে যাচ্ছে জেলেপাড়ার পরিবারগুলো
নদীতে মাছ না পাওয়ায় জেলেরা নৌকা ও জালের খরচ তুলতেই পারছেন না। অনেকেই বেসরকারি মহাজন কিংবা এনজিও থেকে উচ্চসুদের ঋণ নিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেন, যা এখন শোধ করার উপায় নেই। প্রতিদিন নৌকা নিয়ে নদীতে গেলেও ফিরছেন হতাশা নিয়ে। ফলে পরিবার চালানো, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চিকিৎসা—সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ মাছ ধরা বাদ দিয়ে ভ্যান চালানো বা দিনমজুরির মতো বিকল্প পেশা বেছে নিচ্ছেন, যা তাদের মর্যাদা ও জীবনের মান নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছবিঃ বিসনেস স্টান্ডের
প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অনিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত জেলে পরিবার
স্থানীয় প্রশাসন দাবি করলেও বাস্তবতা হলো, তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃত জেলে পরিবার বাদ পড়ছে, আর কিছু সুবিধাভোগী ও দালালচক্র সুযোগ নিচ্ছে সরকারি সুবিধার। জেলেরা বলছেন, “নদীতে জীবন ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরি, অথচ সহায়তা পায় তারা যারা নদীর ধারে যায় না।” এ অবস্থায় প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ, প্রকৃত জেলেদের চিহ্নিত করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভিজিএফ প্রদান নিশ্চিত করা হোক। প্রয়োজনে জাতীয় পর্যায়ে নতুন তালিকা প্রণয়ন এবং অনলাইন নিবন্ধন চালু করা যেতে পারে।
পরিবেশ রক্ষায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও বাড়বে
ইলিশ উৎপাদনের সংকট শুধু একটি মৌসুমিক সমস্যা নয়, এটি এখন একটি টেকসই পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য দরকার নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা, প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ, অবৈধ মাছ ধরা বন্ধ করা এবং জেলেদের বিকল্প পেশায় দক্ষতা উন্নয়ন। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে আন্তর্জাতিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, প্রতিবছর এই সংকট আরও বাড়বে এবং ভবিষ্যতে দেশের মাছভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জেলেদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি
জেলেরা কেবল একজন শ্রমিক নয়, তারা বাংলাদেশের নদী, জলজ সম্পদ ও সংস্কৃতির বাহক। তাদের দুর্দশা শুধু একটি শ্রেণির সংকট নয়, এটি জাতীয়ভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। ইলিশ মাছের কম উৎপাদনের কারণে যে সামাজিক ও মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা এবং সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। এক জেলে বলেন, “আমরা ভিখারি না, শুধু চাই আমাদের মতো মানুষগুলোও বাঁচার সুযোগ পাক।” এই কথা যেন আমাদের কানে বাজে এবং আমাদের পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়।