উরুগুয়ের ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুখিকা আর নেই

‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুখিকা আর নেই। উরুগুয়ের এই নেতার মানবিক জীবন ও সংগ্রামী রাজনীতি আজ বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধার প্রতীক। পড়ুন বিস্তারিত। ছবিঃ বিবিসি
‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের হোসে মুখিকা আর নেই
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে হোসে মুখিকা এমন এক নাম, যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও নিজেকে রেখেছিলেন প্রান্তে, সাধারণ মানুষের একজন হিসেবে। উরুগুয়ের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট যেভাবে জীবনযাপন করেছেন এবং রাজনীতি করেছেন, তা আধুনিক কালের অনেক রাষ্ট্রনেতার কাছে এক শিক্ষণীয় উদাহরণ। তাঁর মৃত্যুতে কেবল উরুগুয়ে নয়, সারা পৃথিবীর মুক্তচিন্তা ও মানবিক রাজনীতির অনুসারীরা শোকাহত। ৮৯ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন সেই মানুষটি, যিনি জীবদ্দশায় ক্ষমতাকে নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
সাধারণ জীবনযাপন ও আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
হোসে মুখিকা ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি বিশ্বের নজর কাড়েন তাঁর সরলতা, সাদামাটা জীবন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থাতেও বাস করতেন রাজধানীর বাইরে তাঁর নিজের ক্ষুদ্র খামারে। তার মাসিক বেতন ছিল প্রায় ১২,০০০ মার্কিন ডলার, যার প্রায় ৯০ শতাংশ তিনি দান করে দিতেন দুঃস্থদের জন্য। মুখিকা একবার বলেছিলেন, “আমি দরিদ্র নই, আমি সাদামাটা জীবন পছন্দ করি।” তিনি বাস করতেন টিনের ছাউনি দেওয়া একটি ছোট ঘরে, যেখানে ছিল না কোনো এয়ার কন্ডিশনার বা আধুনিক সুবিধা। এই জীবনধারাই তাঁকে ‘দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ অভিধা এনে দেয়, যা গৌরবের সঙ্গে তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
গেরিলা থেকে রাষ্ট্রনায়ক — এক সংগ্রামী জীবনের গল্প
মুখিকার জীবন ছিল সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রতিচ্ছবি। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে তিনি তুপামারোস নামক এক বামপন্থী গেরিলা সংগঠনের সদস্য হিসেবে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই লড়াইয়ের জন্য তাকে ১৪ বছরের কারাবরণ করতে হয়, যার অধিকাংশ সময় তিনি একাকী বন্দিত্বে কাটান। মুক্তির পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং এক সময় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেও তিনি তাঁর পুরনো সংগ্রামী চেতনাকে বিসর্জন দেননি, বরং রাষ্ট্রকে জনগণের সেবার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সমাজ সংস্কারে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা
হোসে মুখিকার শাসনামলে উরুগুয়ে বহু সামাজিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে। তিনি গাঁজা সেবন বৈধ করেন, সমকামী বিবাহকে বৈধতা দেন এবং নারীর গর্ভপাতের অধিকার নিশ্চিত করেন। এই পদক্ষেপগুলো ল্যাটিন আমেরিকার মতো একটি রক্ষণশীল সমাজে বিপ্লবের নামান্তর ছিল। তাঁর নীতিগুলো ছিল প্রগতিশীল, মানবিক এবং গণতান্ত্রিক। এসব পদক্ষেপে তিনি বিশ্বব্যাপী উদারপন্থী রাজনীতির মুখ হয়ে ওঠেন এবং উন্নয়নশীল দেশের নেতাদের জন্য এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন।

ছবিঃ এনবিসি নিউস
ক্ষমতা গ্রহণ নয়, জনগণের পাশে দাঁড়ানোই ছিল উদ্দেশ্য
অনেক রাজনীতিক যেখানে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করেন, সেখানে হোসে মুখিকা রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং পুনরায় কৃষিকাজে ফিরে যান। তিনি কখনোই রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখেননি, বরং এটি ছিল তাঁর জন্য জনগণের সমস্যা সমাধানের একটি পথমাত্র। মুখিকা বলতেন, “আমাদের উচিত জীবনকে সহজ করে তোলা, জটিল নয়। আমরা শুধু ভোগেই জীবন সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি।” তাঁর এই দর্শন তাঁকে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী করে রেখেছে।
বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন
হোসে মুখিকার মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রপ্রধান ও মানবিক চিন্তাবিদেরা শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অনেকেই তাঁকে ‘নৈতিকতার প্রতীক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো নেতাদের পাশাপাশি মুখিকাও আজ এক মানবিক রাজনীতির কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর স্মরণে লেখা হচ্ছে হাজারো পোস্ট, শেয়ার হচ্ছে তাঁর বক্তব্য, তাঁর জীবনদর্শনের ওপর তৈরি ডকুমেন্টারি ও সাক্ষাৎকার। অনেকেই বলছেন, রাজনীতিতে সত্যিকারের সততার প্রতীক আরেকটি বাতি নিভে গেল।
তরুণ প্রজন্মের জন্য মুখিকা এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা
বর্তমান সময়ে যখন রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সুবিধাবাদ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠছে, তখন হোসে মুখিকার জীবন নতুন প্রজন্মকে দেখায় কিভাবে নৈতিকতা, মানবিকতা ও সততা দিয়েও দেশ পরিচালনা সম্ভব। তাঁর জীবন কেবল একটি ইতিহাস নয়, এটি একটি দর্শন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানুষ হওয়ার পাঠ শেখায়। তিনি দেখিয়ে গেছেন, একজন রাজনীতিক হতে হলে প্রথমে মানুষ হতে হয়।
উন্নত বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও মুখিকার মর্যাদা
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তাঁর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি তাঁর জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছে। বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা থেকে শুরু করে অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাঁর ‘সাদামাটা রাষ্ট্রপতি’ পরিচয়কে সম্মান জানিয়ে তাঁর জীবনী পুনঃপ্রকাশ করেছে। তাঁর নীতিনিষ্ঠতা এবং মানবিকতা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মানদণ্ডের জন্য এক উচ্চপর্যায়ের উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। অনেক উন্নত দেশের নেতারাও মুখিকার জীবন নিয়ে আবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।