৭৫ লাখ ক্ষুদ্র আমানতকারীর জন্য আবগারি শুল্ক অব্যাহতি:

ক্ষুদ্র আমানতকারী

পরবর্তী অর্থবছরে ৭৫ লাখ সাধারণ ব্যাংক হিসাবধারী ক্ষুদ্র আমানতকারীকে আবগারি শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেবে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। ছবিঃ উনস্প্লাশ

সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে স্বস্তিতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী জনগোষ্ঠী

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, সরকার আরও ৭৫ লাখ ক্ষুদ্র আমানতকারীকে আবগারি শুল্ক থেকে অব্যাহতির আওতায় আনতে যাচ্ছে। এটি দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অনেক দিন ধরেই সাধারণ আমানতকারীরা অভিযোগ করে আসছিলেন, তাদের স্বল্প সঞ্চয়ের ওপর অযৌক্তিক হারে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এবার সেই অসন্তোষ নিরসনে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, যার ফলে প্রায় ৭৫ লাখ ক্ষুদ্র আমানতকারী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এক্সসাইজ ডিউটি থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পেতে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন, বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় কর কাটা নিয়ে, সেই প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য এক বড় স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। সরকারের মতে, এতে সাধারণ জনগণ সঞ্চয়ে উৎসাহিত হবে এবং ব্যাংকিং চ্যানেল আরও সক্রিয় হবে।

বর্তমান আইন ও নতুন পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

বর্তমানে, নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশি ব্যালেন্স থাকলে ব্যাংক হিসাবধারীদের আবগারি শুল্ক দিতে হয়। সাধারণত এই সীমা ছিল ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে বিভিন্ন স্তরে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই সীমা আরও উপরের দিকে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, যাতে স্বল্প আয় ও সঞ্চয়ের ব্যক্তিরা করের বোঝা থেকে মুক্তি পান। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তির বা পরিবারের বার্ষিক ব্যালেন্স নির্ধারিত সীমার নিচে থাকবে, তারা সম্পূর্ণরূপে আবগারি শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাবেন।

কারা পড়বেন এই অব্যাহতির আওতায়?

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে লেনদেন হয় এবং যাদের বার্ষিক আমানতের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, তারাই মূলত এই অব্যাহতির সুযোগ পাবেন। বর্তমান অর্থবছরে যেসব গ্রাহকের বার্ষিক ব্যাংক হিসাব ১ লাখ টাকার নিচে রয়েছে, তাদের এক্সসাইজ ডিউটি কাটা হয়েছে। তবে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই সীমা আরও বাড়ানো হবে এবং অনেক কম আয়ের আমানতকারীও এই তালিকায় আসবেন।

ক্ষুদ্র আমানতকারীদের জন্য অর্থনৈতিক প্রভাব

এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের আনুমানিক ৭৫ লাখ সাধারণ আমানতকারী সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের অনেকেই দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা গৃহিণী — যারা সীমিত আয়ে সংসার চালান এবং সঞ্চয় করেন ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য। আবগারি শুল্কের বোঝা অনেকের কাছেই ছিল বিভ্রান্তিকর ও হতাশাজনক। নতুন সিদ্ধান্তে সেই মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমবে, পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর তাদের আস্থা আরও দৃঢ় হবে।এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকার প্রতিবছর প্রায় ৩০০-৫০০ কোটি টাকার এক্সসাইজ ডিউটি হারাবে বলে অর্থনীতিবিদদের অনুমান। তবে সরকার মনে করছে, এই হারানো রাজস্বের চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান হলো জনগণের আস্থা অর্জন ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ বাড়ানো। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের করের আওতা থেকে অব্যাহতি দিলে তা তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সঞ্চয়প্রবণতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

ব্যাংকিং খাত ও ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব

আবগারি শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ফলে ব্যাংকে নতুন হিসাব খোলার হার বাড়তে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। অনেকে ক্যাশে লেনদেন করে ব্যাংকিং এড়িয়ে চলতেন শুধুমাত্র এই শুল্কের কারণে। এখন সেই বাধা কমে গেলে ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং বা ব্যাংক ট্রান্সফার জনপ্রিয়তা পাবে। সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” গঠনে এই পদক্ষেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

বাজেট ২০২৫-২৬

ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

বাজেট প্রস্তাবনায় আর কী বলা হয়েছে?

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “স্বল্প আয়ের আমানতকারীদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। তাই আমরা এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে চাই যাতে সমাজের প্রান্তিক জনগণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে, এবং সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।” এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, নতুন বাজেটে শুধু রাজস্ব আদায় নয়, সামাজিক ন্যায়বিচারকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।বাংলাদেশে ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের ওপর সরকার নির্ধারিত হারে এক্সসাইজ ডিউটি কেটে নেয়। অনেক সময় দেখা গেছে, একজন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী মাত্র কয়েক হাজার টাকা জমা রাখলেও তার থেকে ডিউটি কাটা হয়, যা তার সঞ্চয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই কারণে অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। অতীতে এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছে, যা সরকারকে এই নীতিগত পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করেছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া

দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, “আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে এই ধরনের উদ্যোগ খুবই জরুরি। বহু সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র আবগারি শুল্কের কারণে ব্যাংকে টাকা রাখতে অনিচ্ছুক ছিল। এখন তারা সঞ্চয়ে আরও উৎসাহিত হবেন।” এছাড়া অনেকেই মনে করছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি না ঘটিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে।

রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও সম্ভাব্য সমাধান

যদিও রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা উঠেছে, তবে সরকারের দাবি, এই ক্ষুদ্র শুল্ক মওকুফের ফলে রাজস্বে বড় প্রভাব পড়বে না। বরং আমানতকারীদের সংখ্যা বাড়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী হবে এবং পুঁজি বাজারে বিনিয়োগও বাড়বে। সরকার এ জন্য বিকল্প উৎস থেকে রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা করছে, যার মধ্যে ডিজিটাল সেবা, উচ্চ আয়ের ব্যক্তির ওপর কর বৃদ্ধি ও নতুন কর ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *