এনবিআর কর্মকর্তাদের পূর্ণ কর্মবিরতি প্রত্যাহার, রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বস্তি ফিরলো

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) কর্মকর্তারা তাদের চলমান পূর্ণ কর্মবিরতি কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসায় রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। জেনে নিন বিস্তারিত। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলনের পটভূমি
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর কর্মকর্তারা সম্প্রতি তাদের ঘোষিত পূর্ণ কর্মবিরতি কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন, যা রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের স্বস্তি নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত অসন্তোষ ও ন্যায্য দাবিদাওয়ার আলোকে এনবিআরের মধ্যপর্যায়ের ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা একযোগে কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কর আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এই ধরনের কর্মসূচি শুরুর পর দেশজুড়ে করদাতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা আসায় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে এবং কর্মকর্তারা দায়িত্বে ফিরতে সম্মত হন।
কর্মবিরতির পেছনে প্রধান কারণ ও দাবি
এনবিআর কর্মকর্তারা তাদের আন্দোলনের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক কারণ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে বর্তমান বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাস, পদোন্নতির স্বচ্ছ নীতিমালা, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ, কর প্রশাসনের স্বাধীনতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার সমন্বয়। অনেক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, তারা বছরের পর বছর ধরে একই পদে কাজ করছেন অথচ ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কর আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে প্রযুক্তিগত ও মানবসম্পদের ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই তাদের কাজের গতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল। এসব সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তারা আন্দোলনের পথে নামেন।
সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠক ও সমঝোতা
আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এনবিআরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনায় বসেন। আলোচনায় কর্মকর্তারা তাদের মূল দাবিগুলো তুলে ধরেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কথা গুরুত্ব সহকারে শোনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সরকারের আশ্বাস ছিল যে, একটি যৌথ কমিটি গঠন করে দাবিগুলোর বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান করা হবে। এই উদ্যোগকেই এনবিআর কর্মকর্তারা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।
কর্মসূচি প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও প্রতিক্রিয়া
প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এনবিআর কর্মকর্তারা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহারের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। তারা জানান, জাতির সার্বিক স্বার্থে এবং করদাতাদের অসুবিধা লাঘব করতে তারা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তবে তারা সতর্ক করে বলেন, যদি প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন না হয় তাহলে তারা আবারও আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন। কর্মসূচি প্রত্যাহারের খবর পাওয়া মাত্রই করদাতা মহলে স্বস্তির ছোঁয়া লাগে এবং কর কার্যালয়গুলোতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়।

ছবিঃ ডেইলি ইত্তেফাক
সরকারের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ করণীয়
সরকার এনবিআর কর্মকর্তাদের এই বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে এবং দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখে একটি আধুনিক, দক্ষ ও প্রযুক্তি-ভিত্তিক রাজস্ব প্রশাসন গঠনের লক্ষ্যেই কাজ করবে সরকার। ভবিষ্যতে যেন আর এই ধরনের কর্মবিরতির প্রয়োজন না হয়, সে লক্ষ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার দিকে জোর দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বাভাবিকতা ফিরে আসা
কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর দেশজুড়ে কর অফিসগুলোতে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমসসহ সকল শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দায়িত্বে ফিরেছেন। এতে করে করদাতাদের ফাইল জমা দেওয়া, তথ্য যাচাই ও রিটার্ন জমার প্রক্রিয়া আবার স্বাভাবিক হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের গতি পুনরুদ্ধার হওয়ায় দেশের অর্থনীতি এবং সরকারের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কর প্রশাসনের স্থবিরতা কেটে গিয়ে সক্রিয়তা ফেরায় ব্যবসায়ী মহলেও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
কর্মকর্তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা
এনবিআর কর্মকর্তারা তাদের কর্মস্থলে ফিরে গেলেও তারা জানিয়েছেন যে, দাবি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবিক না হলে ভবিষ্যতে আরও কার্যকর কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে। তবে তারা বিশ্বাস করেন, সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এবং কর ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা দূর হবে। কর্মকর্তারা রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নের অংশ হতে চান, যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে।
NBR কর্মকর্তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম ও রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই সংকটের সমাধান শুধুমাত্র আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সরকারের আন্তরিকতা ও কর্মকর্তাদের সচেতন ভূমিকার ফলে একটি বড় ধরনের প্রশাসনিক অচলাবস্থা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আনতে হলে কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তব পদক্ষেপই হতে হবে মূল চাবিকাঠি।