বেসরকারি এয়ারলাইন্সের সংকট: উড়োজাহাজ শিল্পে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ

অর্থনৈতিক চাপ, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতার মুখে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো কঠিন সংকটে পড়েছে। কী কারণে এই সংকট? বিশ্লেষণ থাকছে বিস্তারিত প্রতিবেদনে। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
উড়ানের উচ্চতা কমছে, ভয়াবহ আর্থিক চাপে এয়ারলাইন্স খাত
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো বর্তমানে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কারণে এই খাতটি চাপের মুখে রয়েছে, যার মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মার্কিন ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বিমান ভাড়ার অস্বাভাবিক ওঠানামা অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে অনেক সংস্থা তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে এনেছে, আবার কেউ কেউ বন্ধ করে দিয়েছে নির্দিষ্ট কিছু আন্তর্জাতিক রুট।
বেসরকারি এয়ারলাইন্সের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো জ্বালানি খরচ। আন্তর্জাতিক বাজারে জেট ফুয়েলের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় এয়ারলাইন্সগুলোকে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে ফুয়েলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি হওয়ায় দেশীয় কোম্পানিগুলোর উপর আরও বড় চাপ পড়ছে। জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য পরিচালন ব্যয় যেমন—কর্মচারীর বেতন, যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণ, বিমান ভাড়া ইত্যাদির খরচও বেড়েছে অনেক গুণ।
যাত্রী সংকট ও বিমানের আসন খালি থাকার সমস্যা
বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে যাত্রী না পাওয়া এখন একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়ছে না। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রুটে বড় বড় বিদেশি এয়ারলাইন্সের উপস্থিতি দেশীয় সংস্থাগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্লাইট পরিচালনায় ব্যয়বহুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও যদি আসন খালি থাকে, তাহলে তা কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমানে বেশ কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে বিমান কেনা বা ভাড়া নেওয়া হলেও ব্যবসা মুনাফায় না উঠলে সেই ঋণ শোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাংকগুলোও নতুন করে এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে। কিছু এয়ারলাইন্স এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তারা নিজেদের অপারেশন খরচই মেটাতে পারছে না, ফলে কর্মী ছাঁটাই ও সার্ভিস বন্ধের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রশাসনিক জটিলতা ও নীতিগত বাধা
বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সংকট কেবল আর্থিক নয়, প্রশাসনিক দিক থেকেও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময়, নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতির জটিলতা, বিদেশি রুট বরাদ্দে বৈষম্য ইত্যাদি সমস্যাগুলো এভিয়েশন খাতের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক উদ্যোক্তা সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় এই খাতে বিনিয়োগ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সসহ বহু নামী প্রতিষ্ঠান এখানকার যাত্রীবাহী বাজার দখল করে নিচ্ছে। তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু, সেবা মান এবং বহর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো পিছিয়ে পড়ছে। এমন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকতে হলে অভ্যন্তরীণ কাঠামো, সেবা মান ও মার্কেটিংয়ে আরও উন্নতি প্রয়োজন।
সম্ভাবনা আছে, প্রয়োজন সরকারি নীতিগত সহায়তা
যদিও বর্তমানে বেসরকারি এয়ারলাইন্স খাত সংকটে রয়েছে, তবে এর সম্ভাবনাও অসীম। বাংলাদেশ একটি উচ্চ জনসংখ্যার দেশ, এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এয়ারলাইন্স খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হলে সরকারকে কার্যকর নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। জ্বালানিতে ভর্তুকি, ট্যাক্স ছাড়, সহজ ঋণ সুবিধা, এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করলে আবারো এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন নতুন কৌশল গ্রহণ। বিমানের বহর হালনাগাদ, খরচ কমানো, ডিজিটাল বুকিং ব্যবস্থা উন্নতকরণ, গ্রাহক সন্তুষ্টির প্রতি নজর দেওয়া এবং নির্দিষ্ট রুটে সঠিক মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ—এই সবই হতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায়। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব এবং জয়েন্ট ভেঞ্চার উদ্যোগ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।