এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া:

খালেদা জিয়া ৪ বা ৫ মে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছেন। তার ফিরে আসা নির্ভর করছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের প্রাপ্যতার উপর। ছবি: প্রথম এলো
দেশে ফেরা নির্ভর করছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের উপর
বিএনপি চেয়ারপারসন ও বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খালেদা জিয়া বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। তিনি গত জানুয়ারিতে লন্ডনে যান এবং সেখানে দীর্ঘ চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। এখন তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন এবং দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে, এ ফেরার তারিখ এখনও চূড়ান্ত নয়—তা নির্ভর করছে একটি বিশেষ ব্যবস্থাপনার উপর, সেটি হলো এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার জানান, “যদি নির্দিষ্ট সময়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়, তাহলে ৪ মে দেশে ফিরবেন। না হলে ৫ মে নিয়মিত ফ্লাইটে ফিরবেন।”
এ তথ্য জানার পর থেকেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের মাঝে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। বিশেষত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার প্রত্যাবর্তন অনেক কিছু বদলে দিতে পারে—এমন বিশ্বাস দলের নেতাকর্মীদের মাঝে দৃঢ় হয়েছে।
এনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। দেশে ফেরার বিষয়ে এখনো নির্দিষ্ট দিন চূড়ান্ত না হলেও ৪ অথবা ৫ মে তার ঢাকায় ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, তার চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার জন্য একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেলে তিনি ৪ মে ঢাকা আসবেন, আর না হলে বাংলাদেশ বিমানের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে করে ৫ মে দেশে ফেরার পরিকল্পনা আছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, যেহেতু তার শারীরিক অবস্থা বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন, তাই সাধারণ ফ্লাইটে যাত্রা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
লন্ডনে চিকিৎসার পেছনের গল্প: কাতারের আমিরের উদ্যোগে ভ্রমণ
খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার পুরো যাত্রা ছিল বিশেষ ব্যবস্থায় পূর্ণ। ৮ জানুয়ারি তিনি কাতারের দোহা হয়ে একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনে যান। এই গোপন ও সুসজ্জিত ভ্রমণের পুরো প্রক্রিয়াটির পেছনে ছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, যিনি নিজে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এটি শুধু একটি চিকিৎসা সফর ছিল না, এটি ছিল একটি কূটনৈতিক বার্তা—যেখানে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোও খালেদা জিয়ার সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত।
লন্ডনে পৌঁছেই খালেদা জিয়া ভর্তি হন খ্যাতনামা “The London Clinic”-এ। এই ক্লিনিকে তিনি মোট ১৭ দিন ছিলেন, যেটি ব্রিটেনের একাধিক রাজপরিবার ও অভিজাত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য পরিচিত। তার চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন লিভার, কিডনি, হৃদরোগ ও বাতজনিত রোগ বিশেষজ্ঞেরা। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে সব ধরনের মিডিয়া থেকে তার অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল।
২০২৫ সালের জানুয়ারির শুরুতে, বিশেষভাবে সাজানো একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে খালেদা জিয়া লন্ডনে পৌঁছান, যেখানে তাকে “The London Clinic”-এ ভর্তি করা হয়। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সৌজন্যে এই যাত্রার ব্যবস্থা হয়েছিল। হাসপাতালে তিনি টানা ১৭ দিন ভর্তি ছিলেন এবং সেই সময়ে তার শরীরে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা চলে। এর মধ্যে ছিল তার লিভার ও কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা পর্যবেক্ষণ এবং নিয়মিত হিমোডায়ালাইসিস। বর্তমানে তিনি তার বড় ছেলে তারেক রহমানের লন্ডনের বাসায় অবস্থান করছেন, যেখানে তার চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে।

ছবি: বিসনেস স্ট্যান্ডের
শারীরিক অবস্থা: বহুরোগে জর্জরিত একজন রাজনীতিক
৭৯ বছর বয়সী এই প্রবীণ নেত্রী দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তার অন্যতম গুরুতর সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে লিভার সিরোসিস, যা তার দেহে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, কিডনি সমস্যার পাশাপাশি বাতজ্বর ও হাঁটুর ব্যথায় ভুগছেন। তিনি এর আগে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন—বেশিরভাগ সময়ে তিনি ছিলেন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে।
চিকিৎসকদের ভাষায়, তার দেহ বর্তমানে অতি জটিল অবস্থায় রয়েছে এবং যে কোন চিকিৎসাই নিতে হয় অত্যন্ত সতর্কভাবে। এটি ছিল তার জন্য জীবনের আর এক দিক—যেখানে রাজনীতির বাইরে গিয়ে শুধুই একজন রোগী হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
আইনি ও রাজনৈতিক পটভূমি: দীর্ঘ লড়াই শেষে মুক্তি
২০১৮ সালে Zia Orphanage Trust দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যান। তিনি কারাগারে প্রায় দুই বছর ছিলেন। করোনা মহামারির সময় তার পরিবার সরকারের কাছে আবেদন জানায় যেন মানবিক কারণে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালে সরকার সাময়িক মুক্তি দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে।
তবে ২০২৪ সালের আগস্টে দেশে একটি ছাত্র ও জনতার গণআন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলে যায়। রাষ্ট্রপতির আদেশে তাকে পূর্ণ মুক্তি দেওয়া হয় এবং আদালত তার বিরুদ্ধে থাকা দণ্ড বাতিল করে দেন। সেই মুহূর্ত থেকে খালেদা জিয়া ছিলেন আইনি বাধামুক্ত এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার সুযোগ পান।
পরিবারের সাথে যুক্তরাজ্যে ঈদ, ফেরার অপেক্ষায়
চিকিৎসা শেষে তিনি বর্তমানে অবস্থান করছেন লন্ডনে তার ছেলে তারেক রহমানের বাসায়। এবারের ঈদুল ফিতর তিনি অনেক বছর পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উদযাপন করতে পেরেছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন তারেক রহমান, পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিনথি।
পূর্বের চারটি ঈদ তিনি কাটিয়েছেন কারাগারে বা হাসপাতালে। ফলে এবার ঈদের পারিবারিক মিলন তার মানসিক স্বস্তি ও সামাজিক শক্তির পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। সূত্র জানায়, পরিবারের সদস্যরা তার দেশে ফেরার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং যাত্রার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন প্রায়।
প্রত্যাবর্তন ও রাজনৈতিক প্রভাব: নতুন দিন, নতুন প্রশ্ন
খালেদা জিয়ার দেশে প্রত্যাবর্তন কেবল একটি ব্যক্তিগত বা চিকিৎসাগত বিষয় নয়—এটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য একটি বড় ঘটনা। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তার উপস্থিতি আবারও বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বের ভারসাম্য আনবে, যা দলের অভ্যন্তরীণ সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।
এই প্রত্যাবর্তন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতে সহায়ক হবে। যদিও খালেদা জিয়া এখনো সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কি না তা স্পষ্ট নয়, তবুও তার উপস্থিতি দলীয় নীতি ও কৌশল নির্ধারণে অনস্বীকার্য প্রভাব ফেলবে।
বেগম খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়ে শুধু দলীয় কর্মী-সমর্থকরাই নয়, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও গভীরভাবে আগ্রহী। তার ফেরার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত না হলেও পরিকল্পনাগুলো প্রায় প্রস্তুত। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে যাত্রা হলে সেটা হবে আরামদায়ক ও নিরাপদ। তবে সাধারণ ফ্লাইটের বিকল্প ব্যবস্থাও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার এই ফেরা একধরনের প্রত্যাবর্তনের বার্তা বহন করে—ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও জাতীয় স্তরে।