টোকিওর নিক্কেই ফোরামে ড. ইউনুসের বার্তা:

নিক্কেই ফোরামে ড. মুহাম্মদ ইউনুস এশিয়াকে যৌথ সমৃদ্ধির আলোকবর্তিকা হিসেবে রূপান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন। সামাজিক ব্যবসা ও টেকসই উন্নয়নের মডেল তুলে ধরেছেন তিনি। বিস্তারিত জেনে নিন ইউনুসের দৃষ্টিভঙ্গি। ছবিঃ উয়ানভি
এশিয়াকে পরিণত করুন যৌথ সমৃদ্ধির আলোঘরে”
টোকিওতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন নিক্কেই ফোরাম ২০২৫-এ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস এক আবেগপূর্ণ বক্তব্যে বলেন, “এশিয়াকে আমাদের এমন এক অঞ্চলে রূপান্তর করতে হবে যা হবে মানবিকতা ও সমবায়ের প্রতীক।” তিনি এশিয়ার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে বলেন, এই উপমহাদেশে সম্ভাবনার অভাব নেই, শুধু প্রয়োজন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের। তার মতে, এশিয়া যদি এখন থেকে সামাজিক সমতা, টেকসই উন্নয়ন এবং মানবিক ব্যবসার দিকে মনোযোগ দেয়, তাহলে এটি একটি নতুন বিশ্বমানবিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।
নিক্কেই ফোরামের গুরুত্ব এবং ইউনুসের অংশগ্রহণ
নিক্কেই ফোরাম হচ্ছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনৈতিক সম্মেলন, যেখানে রাষ্ট্রনেতা, উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকেরা মিলিত হন। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল “Shared Prosperity and Innovation”, যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। ড. ইউনুস তাঁর বক্তব্যে বলেন, “আমরা যদি শুধুমাত্র ধনী সম্প্রদায়ের উন্নয়নের দিকে নজর দিই, তবে বাস্তব উন্নয়ন সম্ভব হবে না। উন্নয়নের প্রকৃত মাপকাঠি হলো সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটি কেমন আছে, তা দেখা।”
ইউনুসের ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি
ড. ইউনুস তার স্বকীয় চিন্তাধারার মাধ্যমে তুলে ধরেন, সামাজিক ব্যবসা এমন এক ব্যবসায়িক কাঠামো, যা মুনাফা নয়, বরং সামাজিক সমস্যা সমাধানে উৎসর্গীকৃত। তিনি বলেন, “একটি কোম্পানি যদি এমনভাবে পরিচালিত হয়, যার মূল লক্ষ্য হলো সমাজের জন্য কাজ করা, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা এবং মানবতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করবে।” তিনি উল্লেখ করেন, এই মডেল ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশও যদি এই পথে এগোয়, তবে সমগ্র অঞ্চলটিই একটি যুগান্তকারী রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে।
Yunus Centre গত এক দশকে বিশ্বের নানা দেশে সফলভাবে সামাজিক ব্যবসার প্রকল্প চালু করেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে কেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ড. ইউনুস জানান, “আমরা দেখেছি, সমাজের সাধারণ মানুষদের হাতেই রয়েছে পরিবর্তনের চাবিকাঠি। আমরা শুধু তাদের সুযোগ করে দিয়েছি, আর তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছে টেকসই উদ্যোগ।” এই সেন্টার ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক ব্যবসার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।

ছবিঃ ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস
পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি
ড. ইউনুস তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্মই ভবিষ্যতের এশিয়া গড়বে। তাদের মধ্যে রয়েছে নতুন চিন্তার সাহস, প্রযুক্তির দক্ষতা এবং সমাজ পরিবর্তনের আগ্রহ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যদি তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়, তাহলে তারাই হতে পারে সবচেয়ে বড় রূপান্তরকারী।” এজন্য সরকার, বেসরকারি খাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান, যেন তরুণরা প্রয়োজনীয় সহায়তা ও প্ল্যাটফর্ম পায়।
সমৃদ্ধির বণ্টনে সমতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান
“যৌথ সমৃদ্ধি” বলতে ড. ইউনুস বোঝান এমন একটি অর্থনীতি, যেখানে সম্পদের বণ্টন হয় সমভাবে এবং কেউ পিছিয়ে থাকে না। তিনি বলেন, “উন্নয়ন যদি কেবল কিছু মানুষের জন্য হয়, তাহলে সেটি কখনোই টেকসই নয়। উন্নয়নের প্রকৃত মানে হলো সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগোনো।” এই দর্শনের মাধ্যমে এশিয়া একটি ন্যায্য, সহানুভূতিশীল এবং মানবিক সমাজের রূপ দিতে পারে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি থাকবে সামাজিক ন্যায়বিচার।
পরিবেশগত সংকট সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ড. ইউনুস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এশিয়ার জন্য এক বিশাল হুমকি, বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য। তিনি বলেন, “সামাজিক ব্যবসার মডেল এমনভাবে গঠিত হওয়া উচিত, যাতে তা পরিবেশবান্ধব হয়।” পাশাপাশি তিনি জানান, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (SDGs) বাস্তবায়নে সামাজিক ব্যবসা অত্যন্ত কার্যকর একটি হাতিয়ার হতে পারে। বিশেষত Goal-1 (দারিদ্র্য নির্মূল), Goal-8 (সমাজে কাজের সুযোগ সৃষ্টি), এবং Goal-13 (জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা) অর্জনে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা
বক্তব্যের শেষাংশে ড. ইউনুস উপস্থিত আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, “এশিয়া একা এগোতে পারে না; আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।” তিনি বলেন, “এশিয়া যদি যৌথভাবে এগোয়, তবে তা পুরো বিশ্বের জন্য একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠবে।” তিনি সরকারের নীতি-নির্ধারকদের, ব্যবসায়ীদের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানান যাতে তারা মানবিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে যৌথ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে আসে।
graduated from Elizabeth’s St. Mary of the Assumption https://www.en.wikipedia.org/wiki/Chuck_Feeney .