বাংলাদেশের জন্য ওয়েলবিয়িং শিক্ষা অপরিহার্য

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ওয়েলবিয়িং শিক্ষার গুরুত্ব আজ সময়ের দাবি। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সচেতনতা এবং জীবনের দক্ষতা অর্জনে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে ভূমিকা রাখে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনটিতে। ছবিঃ উন্ফপি
ওয়েলবিয়িং শিক্ষার ধারণা ও আধুনিক প্রয়োজন
ওয়েলবিয়িং শিক্ষা বলতে বোঝায় এমন একটি শিক্ষা পদ্ধতি যা শিক্ষার্থীদের কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং তাদের মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক সুস্থতাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিকাশ করে। এটি এমন একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে শিশুরা নিজের অনুভূতি বুঝতে শেখে, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সহনশীলতা গড়ে তোলে, এবং সামাজিক আচরণ সম্পর্কে সচেতন হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রায়শই উচ্চচাপ, পারিবারিক প্রত্যাশা এবং পরীক্ষামূলক প্রতিযোগিতায় মানসিক ভারসাম্য হারায়, সেখানে ওয়েলবিয়িং শিক্ষা হতে পারে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা। আধুনিক সমাজে কেবলমাত্র তথ্যভিত্তিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়—শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের মানসিক ও আবেগীয় বোধের বিকাশ জরুরি।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বহু বছর ধরে পরীক্ষাভিত্তিক এবং মুখস্থ নির্ভর শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়ে আসছে। ফলে শিক্ষার্থীরা মূলত পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করতেই বেশি মনোযোগ দেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় জীবন দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ বা সমস্যা সমাধানের মত বাস্তব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি চর্চার সুযোগ থাকে না। এই কারণে বহু শিক্ষার্থী শুধুমাত্র একাডেমিক পরীক্ষায় ভালো করলেও বাস্তব জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে হেরে যায়। ওয়েলবিয়িং শিক্ষা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারে, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস, সহানুভূতি এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে, যা জীবনের যেকোনো স্তরে সফল হতে সহায়ক।
তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট
বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা অনেক বেশি মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার, পারিবারিক সমস্যাবলি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং শিক্ষাগত প্রতিযোগিতার চাপে তারা বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং হতাশায় আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই মানসিক সংকট শিক্ষার্থীদের আত্মঘাতী চিন্তার দিকে ঠেলে দেয়, যা একটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। ওয়েলবিয়িং শিক্ষা যদি স্কুল পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবর্তন করা হয়, তাহলে তারা নিজেদের অনুভূতি বুঝতে পারবে, মানসিক চাপ মোকাবেলার কৌশল শিখবে এবং আত্ম-সচেতন হয়ে উঠবে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে শিশুরা শুরু থেকেই সচেতন হবে।
জীবনদক্ষতা শেখানোর গুরুত্ব
শুধু একাডেমিক জ্ঞান থাকলেই জীবন সফল হয় না, বরং বাস্তব জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে প্রয়োজন কিছু বিশেষ দক্ষতা। যেমন—যোগাযোগ কৌশল, আত্মনিয়ন্ত্রণ, দলে কাজ করার ক্ষমতা, সংকট মোকাবেলার কৌশল, সহানুভূতি, এবং নেতৃত্বের গুণাবলি। ওয়েলবিয়িং শিক্ষা এই দক্ষতাগুলোর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই এই ধরনের দক্ষতা অনুশীলন করতে পারে, তাহলে তারা সমাজে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। স্কুল পর্যায়ে এই শিক্ষা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জও সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারবে।

ছবিঃ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ব্লগ
শিক্ষকদের মানসিক প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ
ওয়েলবিয়িং শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমানে অনেক শিক্ষক নিজেরাই মানসিকভাবে প্রস্তুত নন কিংবা এই বিষয়ে প্রশিক্ষিত নন। ওয়েলবিয়িং শিক্ষাকে সফল করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মানসিক স্বাস্থ্য, আচরণ বিজ্ঞান, এবং শিশু মনোবিজ্ঞানের বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা আবশ্যক। এছাড়া, শিক্ষকরা যেন শিক্ষার্থীদের মানসিক সংকট বুঝে সহানুভূতির সাথে সহায়তা করতে পারেন—এটা নিশ্চিত করা দরকার। একজন প্রশিক্ষিত ও সচেতন শিক্ষক শুধু পড়া শেখাবেন না, বরং একজন পরামর্শদাতা, পথপ্রদর্শক এবং অভিভাবকের মতো শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াবেন।
সরকারের নীতিগত উদ্যোগের প্রয়োজন
ওয়েলবিয়িং শিক্ষাকে শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুপরিকল্পিত নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। নতুন পাঠ্যক্রমে জীবনদক্ষতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাছাড়া প্রতিটি স্কুলে একজন মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শক বা কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে সহজেই মানসিক সহায়তা পেতে পারে। বাজেটে এই খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা এবং দেশের শিক্ষকদের ওয়েলবিয়িং শিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলার মধ্য দিয়ে একটি মানবিক ও সচেতন শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।
বাস্তব উদাহরণ ও সুফলের প্রমাণ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওয়েলবিয়িং শিক্ষা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ইতিবাচক। ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো দেশগুলোতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমেছে, আত্মহত্যার হার কমেছে এবং একাডেমিক পারফরম্যান্সের পাশাপাশি তাদের সামাজিক আচরণেও উন্নতি দেখা গেছে। এই দেশগুলোতে শিশুদের মধ্যে সহানুভূতি, আত্মবিশ্বাস এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও যদি এই পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে চালু করা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও মানবিক, সচেতন এবং আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে।