কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি উচ্চশিক্ষার আত্মা মুছে ফেলছে?

প্রযুক্তি ও শিক্ষা

AI প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার উচ্চশিক্ষাকে কার্যকর করে তুলছে বটে, কিন্তু এর কারণে কি হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার মানবিক দিক ও আত্মা? বিশ্লেষণে পড়ুন বিস্তারিত। ছবিঃ পেক্সিয়ালস

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগ্রাসন ও উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI বর্তমানে শুধু প্রযুক্তিগত খাতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং দ্রুতগতিতে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে, বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে এখন স্বয়ংক্রিয় গ্রেডিং সিস্টেম, ভার্চুয়াল সহকারী, এবং কনটেন্ট জেনারেশন টুল ব্যবহৃত হচ্ছে, যা শিক্ষার গতি ও সরলতা বাড়ালেও একটি বড় প্রশ্ন তুলছে—এই যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতরে শিক্ষার আত্মা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য তো কেবল তথ্য গ্রহণ নয়, বরং ছাত্রের মধ্যে চিন্তার বিকাশ, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। AI এই জায়গায় এসে পড়লে, মানবিক দিকটি কি হারিয়ে যাচ্ছে না?

একজন শিক্ষক কেবল পাঠদাতা নন, তিনি একজন দিকনির্দেশক, মূল্যবোধ শেখানো অভিভাবক। কিন্তু যখন একটি ক্লাসে AI সফটওয়্যারই সিলেবাস তৈরি করে, শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং এমনকি মূল্যায়নও করে, তখন শিক্ষক শুধু একজন প্রযুক্তি পরিবেশক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকের আন্তরিক ও নৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। একজন শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীর চোখে শুধু একজন প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে, তখন শেখার আনন্দ ও মানসিক সংযোগ হারিয়ে যায়। শিক্ষার এই মানবিক বন্ধন ভেঙে গেলে উচ্চশিক্ষা শুধু ডিগ্রি অর্জনের যন্ত্রে পরিণত হয়।

মানবিক শিক্ষার বিকল্প নয় AI

AI যতই শক্তিশালী হোক, তা মানবিক অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ, সহানুভূতি কিংবা নৈতিকতা শেখাতে সম্পূর্ণ অক্ষম। দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস বা সমাজবিজ্ঞান—এইসব বিষয় মানুষের মনন ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের জন্য অপরিহার্য। AI এগুলো বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু তা উপলব্ধি করতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী যখন প্লেটোর দর্শন পড়েন, তিনি তা শুধু তথ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না, বরং তা থেকে জীবনের গভীরতা অনুধাবনের চেষ্টা করেন। এই অভিজ্ঞতা কোনো অ্যালগরিদম দিতে পারে না, যা শিক্ষা ব্যবস্থার গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করে।

শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে

বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা AI-চালিত চ্যাটবট দিয়ে সহজেই গবেষণা পেপার, প্রেজেন্টেশন কিংবা এসাইনমেন্ট প্রস্তুত করছে। ফলে তাদের নিজস্ব চিন্তা, বিশ্লেষণ কিংবা সৃজনশীলতা চর্চার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। তারা উত্তর তৈরি করছে, কিন্তু প্রশ্ন তুলছে না—যা একটি শিক্ষিত জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। AI যেহেতু অধিকাংশ উত্তর প্রস্তুত করে দিচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কেবল সেই উত্তর মুখস্থ করে যাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ায় তারা আত্মসমালোচনামূলক চিন্তা ও সৃজনশীলতার গুণাবলি হারিয়ে ফেলছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র্য তৈরি করবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

ছবিঃ কলেজ অফ এডুকেশন

পাঠ্যক্রমে বাণিজ্যিকীকরণ এবং AI নির্ভরতা

অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে এবং “কার্যকর” শিক্ষাদান নিশ্চিতে AI নির্ভর হয়ে উঠছে। এতে প্রযুক্তিগত সুবিধা যেমন বাড়ছে, তেমনি মানবিক যোগাযোগ ও শিক্ষার আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার ব্যবসায়ীকীকরণ এবং মুনাফার দৃষ্টিকোণ থেকে AI ব্যবহার বাড়ছে, যেখানে শিক্ষার্থী কেবল একটি “ডেটা ইউনিট” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে করে পাঠ্যক্রম হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত, যান্ত্রিক এবং মানবিক ভাবনার বাইরে, যা উচ্চশিক্ষার মৌলিক কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সমাজে বৈষম্যের আশঙ্কা

AI-চালিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে প্রয়োজন ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, সফটওয়্যার এবং নিরবচ্ছিন্ন প্রযুক্তিগত সাপোর্ট। অথচ দেশের বহু শিক্ষার্থী এসব সুবিধার বাইরেই রয়েছে। ফলে উচ্চশিক্ষা আরও বেশি সুবিধাপ্রাপ্তদের দিকে ঝুঁকছে এবং প্রান্তিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আরও পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এই প্রযুক্তিগত বৈষম্য শিক্ষাকে সবাইকে জন্য সমানভাবে গ্রহণযোগ্য রাখার পরিবর্তে, একে আরও বর্ণগত ও শ্রেণিভিত্তিক করে তুলছে। ফলে সমাজে নতুন একটি ‘ডিজিটাল বৈষম্য’ তৈরি হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

শিক্ষার আত্মা রক্ষায় এখনই ভাবার সময়

শিক্ষা শুধু মস্তিষ্কের নয়, বরং হৃদয়ের চর্চাও। আজ যদি আমরা কেবল প্রযুক্তিকে শিক্ষার চালক বানিয়ে দিই, তাহলে আগামী প্রজন্ম দক্ষ হতে পারে, কিন্তু মানবিক হবে না। আমরা যদি শিক্ষাকে যান্ত্রিকতায় ঢেকে ফেলি, তাহলে একসময় এই জাতি কেবল কর্মক্ষম হবে, বিবেকবান নয়। AI অবশ্যই সময়ের দাবি, তবে তা যেন শিক্ষার আত্মাকে গ্রাস না করে—এই সচেতনতা এখনই দরকার। উচ্চশিক্ষাকে বাঁচাতে হলে, আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষার মানবিক দিক রক্ষা করে কিভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যায়, কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *