গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত শতাধিক: মানুষের ওপর ভয়াবহ আঘাত

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সর্বশেষ আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০০ জন, অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। উদ্ধারকর্মীরা পরিস্থিতিকে ‘নরকসম’ আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত পড়ুন। ছবিঃ এএফপি
গাজার রাত যেন মৃত্যুপুরী: ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১০০+
গাজা উপত্যকার শান্ত সন্ধ্যা হঠাৎই পরিণত হয় এক বিভীষিকাময় রাতে, যখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের ধারাবাহিক বোমাবর্ষণে কেঁপে উঠে পুরো অঞ্চল। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, এই ভয়াবহ আক্রমণে অন্তত ১০০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও শতাধিক। মৃতদের অধিকাংশই শিশু, নারী ও সাধারণ নাগরিক। রাতভর চলা এ হামলায় গাজার বহু এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অসহায় মানুষের চিৎকার, মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা লাশ—এই দৃশ্যগুলো যেন বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়া দিচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই।
জায় এবারের হামলার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, হাসপাতাল সংলগ্ন ভবন, বাজার এবং স্কুল। বোমাবর্ষণ এতটাই হঠাৎ শুরু হয়েছিল যে কেউ পালানোর সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। গৃহবন্দী মানুষজন নিজের ঘরেই মৃত্যু বরণ করেন। গাজার সর্ববৃহৎ শিশু হাসপাতাল আল-রন্তিসির আশেপাশে বিস্ফোরণে বহু শিশু এবং চিকিৎসাকর্মী আহত হন। উদ্ধারকারীরা জানান, ধ্বংসস্তূপ সরাতে গিয়ে বহু শিশুর নিথর দেহ পাওয়া গেছে। শুধু মানুষের প্রাণ নয়, ধ্বংস হয়ে গেছে হাজারো স্বপ্ন, জীবন সংগ্রামের আশ্রয়, বহু বছরের সংগ্রামে গড়া বাড়িঘর।
ইসরায়েলের দাবি ও হামলার বৈধতা নিয়ে বিতর্ক
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা হামাস এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে এই অভিযান পরিচালনা করেছে। তাদের ভাষায়, এটি ছিল “নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ”। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। গাজার জনগণ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্যমতে, এই আক্রমণ ছিল নিরীহ সাধারণ জনগণের ওপর কেন্দ্রিত। শিশুরা মারা যাচ্ছে, নারীরা আহত হচ্ছেন, আবাসিক ভবন ধ্বংস হচ্ছে—এগুলো কি কৌশলগত লক্ষ্য? আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা এটিকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন এবং একটি স্বাধীন তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন।
এই বেদনাদায়ক হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এত বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত উদাহরণ।” ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই হামলার তীব্র সমালোচনা করেছে এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভকারীরা গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আহত শিশুদের ছবি বিশ্ববাসীর হৃদয়ে প্রবল আবেগ সৃষ্টি করছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি।

মানবিক সংকট চরমে: চিকিৎসা ও খাদ্যের জন্য হাহাকার
গাজায় বিদ্যমান মানবিক সংকট প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিদ্যুৎ না থাকায় চিকিৎসাসেবা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নতুন করে অসংখ্য আহত রোগী আসছে, কিন্তু চিকিৎসকরা অসহায়। খাদ্যের অভাবে বহু পরিবার অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি এবং বিশুদ্ধ পানির সংকট জনস্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্টসহ অন্যান্য সংস্থা সহায়তার চেষ্টা করলেও অবরোধের কারণে কার্যকরভাবে কিছু করা যাচ্ছে না। একাধিক আন্তর্জাতিক এনজিও এই পরিস্থিতিকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ ঘোষণা করেছে।
এই ইসরায়েলি হামলায় শিশুদের মৃত্যু সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশই শিশু। এসব শিশুরা কেউ স্কুলে যাওয়ার কথা ভেবেছিল, কেউ হয়তো ঘুমের মধ্যে মারা গেছে। এমন নিষ্ঠুরতা কোনোভাবেই মানবিকতা বা কৌশলগত প্রয়োজনে যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। এই ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই কেঁদে ফেলেছেন, কিন্তু এই কান্না থামাতে পারছে না ইসরায়েলি বোমা। শিশুদের মৃত্যু এক ভয়ঙ্কর বার্তা দেয়—মানবতা আজ যেন অস্তিত্ব সংকটে।
যুদ্ধ নয়, দরকার শান্তি ও কূটনীতি
গাজার পরিস্থিতি আজ প্রমাণ করছে যে, যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং নতুন করে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এই সংঘাত এখন শুধু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন মানবাধিকারের, বিবেকের ও মানবতার সংকট। প্রয়োজন একটি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা। বিশ্বকে একসাথে দাঁড়াতে হবে এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তির পৃথিবী গড়ে ওঠে। সময় এখনই—মানবতার পক্ষে কথা বলার।