গাজায় এক টুকরো রুটির জন্য পিতা নিহত – ত্রাণ বিতরণে প্রাণঘাতী হুমকি

গাজায় ত্রাণ সংগ্রহের সময় এক পিতা নিহত হন শুধুমাত্র এক টুকরো রুটির জন্য। এই ঘটনা তুলে ধরে গাজার মানবিক সংকটের গভীরতা। বিস্তারিত জানতে পড়ুন। ছবিঃ রেউটার্স
গাজার প্রতিদিনের জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম
গাজায় প্রতিদিনই মানবিক বিপর্যয়ের নতুন চিত্র সামনে আসছে, যা সারা বিশ্বকে নাড়া দিচ্ছে। সম্প্রতি এমন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যেখানে ছয় সন্তানের জনক এক পিতা শুধুমাত্র এক টুকরো রুটি পাওয়ার আশায় প্রাণ হারান। দীর্ঘসময় ধরে খাদ্যাভাবে ভোগা মানুষগুলো যখন ত্রাণ কেন্দ্রের সামনে জড়ো হন, তখন তারা কোনোভাবেই কল্পনা করেন না যে খাবারের আশায় আসা সেই যাত্রা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই ঘটনাটি বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো, যেখানে একটি রুটির দাম একজন মানুষের প্রাণের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘটনার সময় গাজার উত্তরাঞ্চলে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। দিনের পর দিন অনাহারে থাকা মানুষজন আশা করেছিলেন, হয়তো আজ তারা অন্তত একটি খাবার পাবেন। কিন্তু সেই আশাও হয়ে ওঠে মৃত্যুর ফাঁদ। গাজায় ত্রাণ বিতরণ এখন এতটাই অনিরাপদ হয়ে পড়েছে যে অনেকেই জানেন, তারা যদি লাইনে দাঁড়ান, তবে ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই। একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা—এই দুইয়ের চাপে গাজাবাসীর জীবন এখন প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঝুঁকির মুখে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে বিভীষিকার চিত্র
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নিহত ব্যক্তি অত্যন্ত ভোরে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যান যাতে অগ্রাধিকার পান। কিন্তু বেলা বাড়তেই ভিড় অসহনীয় হয়ে ওঠে। এ সময় হঠাৎ করে গুলির শব্দে চারদিক আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ জানান, ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালিয়েছিল। অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নিহত ব্যক্তি রুটি হাতে পাওয়ার আগেই বুকে গুলিবিদ্ধ হন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এমন একটি মৃত্যু এই প্রশ্ন তোলে: একজন মানুষকে খাদ্যের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে কেন?
গাজার মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে
এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের একটি বাস্তব চিত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার জনসংখ্যার বিশাল অংশ এখন সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই সহায়তাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অব্যাহত সংঘাত ও সীমান্ত অবরোধের কারণে। বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা জানিয়েছে, অনেক সময় তাদের গাড়ি আটকে দেওয়া হয়, অথবা পৌঁছানোর আগেই হামলার মুখে পড়তে হয়। ফলে খাদ্য, পানি, ওষুধ – সবকিছুই এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।

ছবিঃ ফ্রান্স ২ ৪
চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে
এত দিন ধরে চলা সহিংসতায় গাজার অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই, ওষুধ নেই, এমনকি পানিরও তীব্র সংকট রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকরা কখনও কখনও একাধিক আহত মানুষের মধ্যে বেছে নিতে বাধ্য হন – কার জীবন বাঁচানো সম্ভব আর কারটা নয়। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ছয় সন্তানের এক পিতার জীবন শেষ হওয়া শুধু দুঃখজনক নয়, বরং তা গাজার হাজার হাজার পরিবারের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলে যারা প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও কার্যকর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার আহ্বান জানালেও যুদ্ধবিরতি বা ত্রাণ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেউই সামনে এসে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গাজার মানুষের জন্য মানবিক করিডোর খুলে দেওয়ার প্রস্তাব অনেকবার এসেছে, কিন্তু তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব প্রকট। ত্রাণবাহী গাড়ির ওপর হামলা চালানো, সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো – এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা এখনও দেখা যায়নি।
নিহত পিতার পরিবার আজ চরম অনিশ্চয়তায়
নিহত পিতার পরিবার এখন সম্পূর্ণভাবে অসহায়। তাঁর ছয়টি সন্তান এখন ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। গাজার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় একজন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু মানে শুধুমাত্র একটি শোক নয়, বরং একটি পরিবারের অস্তিত্ব সংকট। প্রতিবেশীরা বলছেন, এই পরিবারের ছোট শিশুরা এখন জানে না তাদের ভবিষ্যত কী হবে। আশ্রয়, খাদ্য এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়াই বেঁচে থাকা এখন তাদের প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ।
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো গাজায় ত্রাণ বিতরণ এখন কেবল মানবিক সহায়তার কার্যক্রম নয়, বরং একটি প্রাণঘাতী রুটিন। প্রতিদিন মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে শুধুমাত্র খাবারের জন্য। বিশ্ব সম্প্রদায় যদি এখনই কার্যকর এবং দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, তবে ভবিষ্যতে আরও অসংখ্য মানুষ এমন করুণ পরিণতির শিকার হবে। এখনই সময় গাজার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর – না হলে প্রতিদিনই এমন নতুন মৃত্যুর খবর আমাদের হৃদয় ভেঙে দেবে, কিন্তু কিছুই বদলাবে না।