গাজায় কয়েক দিনের মধ্যে ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা

ফিলিস্তিন শিশুর অবস্থা

জাতিসংঘ গাজায় চরম মানবিক সংকটের বিষয়ে সতর্ক করে জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই খাদ্য ও ওষুধের অভাবে ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হতে পারে। ছবিঃ ডেইলি অবসাবের

জাতিসংঘের সতর্কবার্তা: গাজায় কয়েক দিনের মধ্যে ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা

জাতিসংঘ সম্প্রতি গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ ও মানবিক সংকটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবরোধ এবং যুদ্ধবিগ্রস্থ এলাকায় খাবার ও চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের অভাবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। গাজা উপত্যকায় এক দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংঘাতের মাঝেও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা একযোগে সতর্ক করে দিয়েছে যে, যদি অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সহায়তা না পৌঁছে, তবে এই মানবিক বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তারা এখন ত্বরিত পদক্ষেপের আবেদন জানাচ্ছে, কারণ গাজার শিশুদের জীবন রক্ষায় সময় হাতে নেই।

অনাহার ও অপুষ্টির কারণে গাজার শিশুরা বিপদে

গাজায় খাদ্য সংকটের কারণে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইউনিসেফসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার মতে, বহু শিশু ইতিমধ্যেই মারাত্মক খাদ্য ঘাটতিতে ভুগছে, যার ফলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। খাদ্যের অভাব কেবলমাত্র দেহের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে না, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গাজার শিশুদের অনেকেই ঠিকমতো সঠিক পুষ্টি না পাওয়ায় তাদের বৃদ্ধির হার থেমে গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নবজাতক ও ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এই অপুষ্টি প্রাণঘাতী হতে পারে, কারণ তাদের শরীর দ্রুত বিকশিত হয় এবং ছোটখাট অসুস্থতাও বড় সমস্যায় পরিণত হতে পারে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও জরুরি চিকিৎসার অভাব

গাজায় চলমান সংঘর্ষের কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো আংশিক বা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, ওষুধের জোগান বন্ধ হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। এমন অবস্থায় গাজার রোগীদের, বিশেষ করে শিশুদের, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। অনেক শিশুর ইনকিউবেটর, জরুরি মেডিকেল কেয়ার এবং লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রপাতি নেই। এছাড়াও, চিকিৎসক ও নার্সের অভাব ও নিরাপত্তার সংকটের কারণে হাসপাতালগুলো সঠিক সেবা দিতে পারছে না। ফলে শিশুদের মৃত্যু মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই সংকটকে একটি “মানবিক দুর্যোগ” হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মেডিকেল সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে।

নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়ায় শিশুরা অতিরিক্ত ঝুঁকিতে

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ঘরবাড়ি হারিয়ে শিশু ও তাদের পরিবারগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে ভুগছে। প্রচণ্ড বোমা হামলা, গোলাবর্ষণ এবং সংঘর্ষে বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। অনেক শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা বা আহত অবস্থায় রাস্তায়, ধ্বংসস্তূপের নিচে বা ত্রাণ শিবিরে বসবাস করছে। এসব শিশুদের ওপর ভয়, মানসিক আঘাত এবং শারীরিক ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ আশ্রয়, স্যানিটেশন, পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করতে না পারায় গাজায় মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে। বিশেষ করে ঠান্ডা রাতগুলোতে শিশুদের শীতলতা, রোগব্যাধি ও অবহেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যা তাদের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি।

গাজায় মানবিক সংকট

ছবিঃ এসবিএস

আন্তর্জাতিক সহায়তার সীমাবদ্ধতা ও বাধা

গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সীমান্ত বন্ধ, অবরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী গাজায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোর কনভয়গুলো অনেক সময় হামলার শিকার হচ্ছে বা গাজার ভেতরে ঢুকতে বাধা পাচ্ছে। এই অবরোধ শিশুদের জন্য জীবনদায়ক সহায়তা সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে গাজায় মানবিক সংকট ক্রমশ তীব্র হচ্ছে এবং শিশুদের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে উঠছে। বিশ্বজুড়ে দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে অবরোধ শিথিল করার ও ত্রাণ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

জাতিসংঘের আহ্বান: যুদ্ধবিরতি ও মানবিক করিডোরের প্রয়োজনীয়তা

জাতিসংঘ সাধারণ সম্পাদক আন্তোনিও গুতেরেস ও ইউনিসেফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজায় একটি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়েছে। তারা বলছে, শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে মানবিক করিডোর খোলা সম্ভব হবে যেখানে নিরাপদে খাদ্য, ওষুধ এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়া যাবে। গুতেরেস বারবার উল্লেখ করেছেন যে শিশুদের জীবন রক্ষা করা মানবতার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, আর এই সংকট থেকে বাঁচাতে বিশ্বকে একতাবদ্ধ হতে হবে। মানবিক করিডোরের মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ করা না গেলে শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে এবং গাজায় মানবিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হবে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকা

জাতিসংঘের এই মারাত্মক সতর্কবার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর সারা বিশ্ব থেকে মানবাধিকার সংগঠন, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এবং স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী গাজায় সহায়তা পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রাজনৈতিক জটিলতা ও সংঘাতের কারণে এই সহায়তা কার্যকরভাবে পৌঁছানো এখনও ব্যাহত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়াতে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা জোরালোভাবে বলছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে শিশুদের জীবন রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *