গাজার ধ্বংসস্তূপে একটি পরিবারের সংগ্রামের করুণ চিত্র

ছবি:বিবিসি
“গাজায় যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশে একটি সাধারণ পরিবার প্রতিদিন খাদ্য, পানি ও নিরাপত্তার সংকটে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। ধ্বংসস্তূপে দিনযাপন ও মানবিক বিপর্যয়ের এই বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেছে এই প্রতিবেদন।”
ধ্বংসস্তূপে বসবাস: মানবতা আজ প্রশ্নের মুখে
গাজা উপত্যকার অনেক বাসিন্দার মতো একটি পরিবার তাদের পুরো ভবিষ্যৎ হারিয়ে বসে আছে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের নিচে। বাড়ির যেখানে ছিল রান্নাঘর, এখন সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ, ভাঙা ছাদ আর পোড়া আসবাব। একসময় যেই ঘর ছিল ভালোবাসা ও শান্তির জায়গা, এখন সেখানে আছে শুধু শোক, অনিশ্চয়তা এবং ক্ষুধা। তারা মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে ঘুমায়, কোনো জানালা নেই, কোনো দরজা নেই। রাতে বৃষ্টি হলে কাপড় টেনে গা ঢাকে, আর দিনের গরমে পানির খোঁজে তীব্র লড়াই চলে। এক সময়ের গর্বিত ঘর এখন একখণ্ড শ্মশান ভূমি যেন।
খাদ্য ও পানির সংকট: ক্ষুধার রাজ্যে অস্তিত্বের প্রশ্ন
গাজায় বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। প্রতিদিন সকালের শুরু হয় এই প্রশ্নে—আজ কিছু খেতে পারবো তো? পরিবারগুলো বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রাপ্ত শুকনো খাবারের দিকে চেয়ে থাকে, তবে সেগুলোও নিয়মিত আসে না। অনেক সময় বাচ্চারা একদিনে একটি মাত্র খাবার খায়, সেটিও হয় ভাঙা বিস্কুট বা চালের পাতলা ভাত। পরিষ্কার পানির অভাবে অনেকে দূষিত পানি খাচ্ছে, যার ফলে ডায়রিয়া, জ্বর ও ত্বকের রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। একটি শিশুর মুখে দেখা যায় পোকায় খাওয়া রুটির শেষ টুকরো মুখে পুরে খাওয়ার চেষ্টা—একটি সভ্যতার বিবেক যেন মুখ থুবড়ে পড়ে।

ছবি:NBC নিউস
চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে: রোগীদের মৃত্যু অবধারিত
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজার বহু হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে বা কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। এখন সামান্য জ্বর, কাশি, এমনকি মারাত্মক ইনফেকশনেও সেবা পাওয়া দুর্লভ। অনেক হাসপাতাল বিদ্যুৎ, ওষুধ ও অক্সিজেন ছাড়াই চলছে। গর্ভবতী নারীরা প্রসবকালীন সেবা পাচ্ছেন না, ফলে অনেক মা ও নবজাতক প্রাণ হারাচ্ছে। ক্যান্সার বা কিডনি রোগীরা দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু চিকিৎসা বা ডায়ালাইসিস পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে অনেক রোগী পথেই মারা যাচ্ছে।
শিশুদের ভবিষ্যৎ: শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এক প্রজন্ম
গাজার শিশুরা এখন আর স্কুলে যায় না, তারা প্রতিদিন রাস্তায়, ধ্বংসাবশেষে, বা ত্রাণ লাইনে দাঁড়িয়ে সময় কাটায়। তাদের অনেকে বাবা-মাকে হারিয়েছে, আবার অনেকেই নিজের চোখে দেখেছে তাদের ঘর ধ্বংস হতে। এই মানসিক আঘাত থেকে তারা অনেকেই রাতে ঘুমাতে পারে না, আতঙ্কে কেঁপে উঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে বা ব্যবহার হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে। এই পরিস্থিতিতে শিশুরা শুধু শিক্ষা থেকেই নয়, এক নিরাপদ শৈশব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এটা শুধু গাজার নয়, মানবতারই হার।

ছবি:NBC নিউস
নিরাপত্তাহীনতা: প্রতিটি মুহূর্ত এক সম্ভাব্য মৃত্যুঝুঁকি
গাজার কোনো বাড়ি, রাস্তা বা হাসপাতাল—কোনোটিই আর নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত আকাশে ড্রোন ঘোরে, হঠাৎ করে বোমা পড়তে পারে যেকোনো স্থানে। অনেক শিশু খেলার সময় নিহত হয়েছে, অনেক নারী ঘর পরিষ্কার করার সময়েই মারা গেছেন। দিনের বেলা যতোটা ভয়, রাতের অন্ধকার যেন আরও ভীতিকর। রাত হলে মানুষ ছাদের বদলে মাটিতে থাকে, আলোর বদলে মোমবাতি বা কিছুই না। যুদ্ধের ভয় আর অনিশ্চয়তা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছে, কিন্তু তবুও তারা বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা ও নিষ্ক্রিয়তা: মানবিক সংকটের সীমানা পেরিয়ে
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দাতাগোষ্ঠী সাহায্যের চেষ্টা করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা যথাযথভাবে পৌঁছায় না। অবরোধ, নিরাপত্তাজনিত জটিলতা এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সহায়তা সীমিত হয়ে গেছে। যেসব পরিবার সবচেয়ে বিপদে আছে, তাদের কাছেও অনেক সময় ত্রাণ পৌঁছায় না। এদিকে আন্তর্জাতিক মহল অনেক সময় শুধু “উদ্বেগ” প্রকাশ করেই থেমে যায়, কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন আসে না। এই পরিস্থিতিতে গাজার সাধারণ মানুষের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ যেন পৃথিবীর চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হয়, কিন্তু বাস্তবিক পরিবর্তন হয় না।

ছবি:NBC নিউস
মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি: এক নীরব মহামারি
গাজার যুদ্ধ শুধুমাত্র দেহে আঘাত দেয়নি, এটি মানুষের মনের ভেতরে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। শিশু, মা-বাবা, বৃদ্ধ—সবাই চরম মানসিক চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। দিনের পর দিন বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে, রাত কাটে দুঃস্বপ্নে। অনেক শিশুরা এখন কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছে, তারা চুপচাপ বসে থাকে — চোখে আতঙ্ক, মুখে বোবা কান্না। বহু মানুষ হতাশায় ভুগছে, আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ সেখানে নেই কোনো মানসিক চিকিৎসা, নেই কাউন্সেলিং সেবা। এই নিরব অথচ মারাত্মক মানসিক বিপর্যয় গাজার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দিতে পারে।
শান্তির আকাঙ্ক্ষা: একটি মানবিক আহ্বান
গাজার প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি মুখে, একটি প্রশ্ন—“এই যুদ্ধ আর কবে শেষ হবে?” তারা শান্তি চায়, নিরাপদে ঘুমাতে চায়, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত সহিংসতা, বোমা হামলা, ধ্বংস, এবং মৃত্যুর ছায়ায় তারা আটকে আছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত শুধু বিবৃতি নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে একটি টেকসই শান্তির পথ বের করতে হবে। এই পরিবারগুলোর আকাঙ্ক্ষা খুব সাধারণ—একটি নিরাপদ জীবন, একটু ভালো খাবার, একটু শান্তি। সেটাই আজ তাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।