গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে ইউরোপের চাপ বেড়ে চলেছে

গাজা যুদ্ধ

ইসরায়েলের গাজা অভিযান নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর উদ্বেগ ও সমালোচনা বাড়ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেসামরিক হতাহতের ঘটনায় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপের মুখে ইসরায়েল। ছবিঃ প্রথম আলো

ইউরোপের অবস্থান আগের চেয়ে আরও কঠোর

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের লাগাতার সামরিক অভিযানের প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় ও কড়া ভাষায় নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করছে। বিশেষ করে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অসংখ্য শিশু ও নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা ইউরোপে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। জার্মানি, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, স্পেনসহ একাধিক দেশের সরকার প্রধানরা একযোগে এ অভিযানের সমালোচনা করে বলছেন, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে গাজায়। তারা ইসরায়েলকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির পথে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট অভিযোগ সামনে এসেছে

ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, গাজা শহরজুড়ে হাসপাতাল, স্কুল, এবং জনবসতি লক্ষ্য করে চালানো হামলাগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পরিপন্থী। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস অভিযোগ তুলেছে, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করছে এবং যুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো লঙ্ঘন করছে। এসব ঘটনার ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ইসরায়েলবিরোধী জনমত শক্তিশালী হচ্ছে।

কূটনৈতিক বক্তব্যে তীব্রতা ও পরিবর্তন

ইউরোপীয় নেতাদের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে, আগের তুলনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাঁদের কূটনৈতিক ভাষ্য অনেক বেশি তীব্র ও খোলামেলা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল সোজাসুজি বলেছেন, “যদি ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মানতে ব্যর্থ হয়, তবে ইউরোপের উচিত কৌশলগত সহযোগিতা পর্যালোচনা করা।” তার এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের সঙ্গে আগের রাজনৈতিক মিত্রতা বজায় রাখার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ তাদের রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে তেলআবিবে কড়া বার্তা পাঠাচ্ছে, যা ইসরায়েলের কূটনৈতিক চাপে থাকার ইঙ্গিত বহন করে।

অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় পরিবর্তনের ভাবনা

ইসরায়েলের প্রতি চাপ বাড়াতে ইউরোপীয় দেশগুলো অস্ত্র সরবরাহ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সীমিত করার চিন্তা-ভাবনা করছে। ইতোমধ্যে স্পেন ও বেলজিয়াম ঘোষণা দিয়েছে তারা ইসরায়েলে নতুন কোনো অস্ত্র সরবরাহ করবে না। এমনকি যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের রাজনৈতিক মহলে এই বিষয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, যদি গাজায় মানবিক বিপর্যয় চলতেই থাকে, তবে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি ও বিনিয়োগ পর্যালোচনা করা হতে পারে। এটি ইসরায়েলের জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে।

ইসরায়েল গাজা হামলা

ছবিঃ বিএসএস

ইউরোপজুড়ে জনমত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে

ইউরোপের বিভিন্ন শহরে গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে। প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন ও ডাবলিনে হাজার হাজার মানুষ সড়কে নেমে এসেছে। বিক্ষোভকারীরা গাজায় হামলার বিরোধিতা করে “স্টপ বোম্বিং গাজা”, “ফ্রি প্যালেস্টাইন” প্রভৃতি স্লোগান দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন বেড়ে চলেছে, এবং এসব আন্দোলন রাজনৈতিক নেতাদের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। গণমাধ্যমগুলোতে গাজা সংকট নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রচার হচ্ছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাড়ছে।

জাতিসংঘে ইউরোপের প্রস্তাব ও উদ্যোগ

ইউরোপীয় দেশগুলো জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতির পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। তারা গাজায় স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে একযোগে জাতিসংঘে একটি নতুন প্রস্তাব তুলেছে, যেখানে ইসরায়েলের সামরিক আচরণ পর্যালোচনার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো গাজায় মানবিক সহায়তা দ্রুত পাঠানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ইসরায়েলকে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।

রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও মানবিক বিষয়ে ঐক্য

ইউরোপে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও গাজা ইস্যুতে একটি মানবিক ঐক্য গড়ে উঠেছে। বামপন্থী দলগুলো তো বটেই, ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যেও অনেকেই ইসরায়েলের সমালোচনা করতে শুরু করেছে। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলপন্থী বলে পরিচিত দলগুলোও গাজায় মানবিক বিপর্যয় দেখে সমালোচনার কণ্ঠে শামিল হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ইউরোপে এখন কেবল রাজনৈতিক না, বরং নৈতিক প্রশ্নেও ইসরায়েলকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *