চট্টগ্রামে ড. ইউনূসের দিনব্যাপী সফর: সামাজিক ব্যবসা, শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ

ড. ইউনূস, চট্টগ্রাম সফর

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামে দিনব্যাপী সফরে সামাজিক ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে অংশ নিলেন। ঘোষণা দিলেন ইউনূস সেন্টারের আঞ্চলিক অফিস স্থাপনেরও। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

চট্টগ্রামে পৌঁছালেন শান্তির দূত ড. মুহাম্মদ ইউনূস
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে একটি বিশেষ ফ্লাইটে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাঁর আগমনে বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয় এবং উপস্থিত ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ইউনূস সেন্টারের প্রতিনিধিরা ও স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা। তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এ সফরটি অনেকদিন পর ড. ইউনূসের চট্টগ্রামে আসা, ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষাজগতের প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।

সামাজিক ব্যবসা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
চট্টগ্রামে তাঁর সফরের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো সামাজিক ব্যবসা কার্যক্রমের অগ্রগতি যাচাই এবং নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা। দুপুরে তিনি একটি বিশেষ বৈঠকে অংশ নেন যেখানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, উদ্যোক্তা ফোরাম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে তিনি বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক ব্যবসার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং বলেন, “আমাদের এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষ এবং পৃথিবী দুটোই একসাথে লাভবান হবে, শুধুমাত্র মুনাফার ভিত্তিতে নয়।”

বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ও তরুণদের মধ্যে অনুপ্রেরণা ছড়ানো
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত বিশেষ সেমিনারে বক্তৃতা দেন ড. ইউনূস, যেখানে তিনি প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীর সামনে সামাজিক ব্যবসা, তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তা এবং মানবিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “তোমরাই ভবিষ্যৎ, যদি তোমরা শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে সমাজ বদলের জন্য উদ্যোক্তা হতে পারো, তবেই বাংলাদেশ সত্যিকারের উন্নয়নের পথে এগোবে।” শিক্ষার্থীদের মাঝে তাঁর বক্তব্য দারুণ সাড়া ফেলে এবং তাঁকে ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর পর্বেও উদ্দীপনা দেখা যায়।

গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে সরেজমিনে উপস্থিতি
বিকেলে তিনি চট্টগ্রামের অদূরে একটি গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে যান, যেখানে দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের গল্প শুনে গভীরভাবে আপ্লুত হন। ইউনূস বলেন, “এই নারীরাই আমাদের সমাজের আসল চালিকাশক্তি। তাদের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়েই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।”

নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশ

ছবিঃ বিসনেস স্টান্ডের

গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তুলে ধরলেন ভিশন ২০৩০
চট্টগ্রামে সফর শেষে ড. ইউনূস স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মিলিত হন। সেখানে তিনি সামাজিক ব্যবসার ভবিষ্যৎ এবং ইউনূস সেন্টারের ‘ভিশন ২০৩০’ তুলে ধরেন। তাঁর মতে, পরবর্তী দশকে সামাজিক ব্যবসা হতে পারে বিশ্বের দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার। তিনি বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে এই বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা
সন্ধ্যায় তিনি চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। এ সভায় তিনি কর্পোরেট সেক্টরকে সামাজিক ব্যবসায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। ইউনূস বলেন, “শুধু CSR নয়, আপনাদের মূল ব্যবসার মডেলের মধ্যেই সামাজিক দায়বদ্ধতা অন্তর্ভুক্ত করুন। এটি ভবিষ্যতের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।” এই বক্তব্য ব্যবসায়ী মহলে নতুন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে।

চট্টগ্রামে ইউনূস সেন্টারের আঞ্চলিক অফিস স্থাপনের ঘোষণা
এই সফরের শেষ পর্যায়ে ড. ইউনূস ঘোষণা দেন যে, ইউনূস সেন্টার শীঘ্রই চট্টগ্রামে একটি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন করবে। এই অফিসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগগুলোকে প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিক সংযোগে সহায়তা দেওয়া হবে। এটি শুধু স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে চলেছে।

জনগণের মুখে ইউনূসের প্রশংসা ও প্রত্যাশা
চট্টগ্রামে ইউনূসের এই সফর ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝেও ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। অনেকেই তাঁর দর্শন ও কাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে জানান যে, “তিনি শুধু একজন অর্থনীতিবিদ নন, তিনি হচ্ছেন মানবতার পথপ্রদর্শক।” চট্টগ্রামের জনগণ প্রত্যাশা করছেন, তাঁর এই সফর নতুন উদ্যম এবং উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সোপান তৈরি করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অঞ্চলটির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *