চট্টগ্রামে ছাত্রসংঘর্ষে আহত ১৫ | উত্তপ্ত শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা জোরদার

চট্টগ্রামে দুই ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষে আহত অন্তত ১৫ জন। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের হস্তক্ষেপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাঠদান বন্ধ। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
সংঘর্ষের সূত্রপাত
চট্টগ্রামের একটি খ্যাতনামা সরকারি কলেজের ক্যাম্পাসে মঙ্গলবার দুপুরে আকস্মিকভাবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসে একটি সাধারণ কর্মসূচি আয়োজন নিয়ে দুই সংগঠনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। দুপুর ১টার দিকে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হলে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হঠাৎ করেই শুরু হয় ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং মারধরের ঘটনা। সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মচারীরা সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
আহতদের অবস্থা ও চিকিৎসা
আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, একাধিক শিক্ষার্থীর মাথা ফেটে গেছে এবং কারও কারও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত লেগেছে। একজন শিক্ষার্থীর পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যার জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। হাসপাতালে ভিড় জমেছে আহতদের পরিবার, সহপাঠী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। চিকিৎসকদের মতে, সংঘর্ষের ধরণ খুবই সহিংস ছিল এবং আহতদের শরীরে যেসব আঘাত লেগেছে তা মারাত্মক ধরনের। আহতদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে আলাদা একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
পুলিশের হস্তক্ষেপ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সংঘর্ষের খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আগেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে সংঘর্ষে লিপ্ত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় কয়েকজনকে আটকও করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ক্যাম্পাসে অস্থায়ীভাবে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে এবং সংঘর্ষের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্তের কাজ চলছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য কলেজ প্রশাসনের অনুরোধে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সকল ধরনের পাঠদান ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এমন সহিংসতা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, শিক্ষাঙ্গন হলো জ্ঞানচর্চা ও উন্নয়নের স্থান, এখানে কোনো ধরনের সহিংসতা মেনে নেওয়া যায় না। ইতোমধ্যে সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটিকে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আরো জানায়, যারা এই সহিংসতার সাথে জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক ও আইনি উভয় ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং সেশন আয়োজনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

ছবিঃ বিসনেস স্টান্ডের
ছাত্র রাজনীতির সম্পৃক্ততা ও বিশ্লেষণ
সংঘর্ষের মূল পেছনে রয়েছে দুই রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে তাদের মধ্যে পুরনো বিরোধ বিদ্যমান, যা সামান্য উত্তেজনায় ভয়াবহ রূপ নেয়। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির এ ধরনের প্রভাব নিয়ে বহু দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও অভিভাবক মহল মনে করেন, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা কমাতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কা রয়েছে। ছাত্র রাজনীতির নেতাদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপই পারে এমন সহিংসতা রোধ করতে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে সংঘর্ষ
ঘটনাস্থলে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আগেই দু’পক্ষ উত্তেজিত ছিল। কেউ কেউ হাতে লাঠি, রড নিয়ে ঘুরছিল, যা দেখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আগেই আশঙ্কা করছিলেন কিছু একটা ঘটবে। এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা ক্লাসে বসে ছিলাম, হঠাৎ বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বের হই। তখন দেখি সবাই দৌঁড়াচ্ছে।” শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শ্রেণিকক্ষ বা লাইব্রেরিতে ছুটে যান। শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকাই এই ধরনের সহিংসতা বাড়াচ্ছে। তারা ক্যাম্পাসে স্থায়ী নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত নজরদারির দাবি জানান।
অতীতের ঘটনা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা
চট্টগ্রামের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে এর আগেও একাধিকবার ছাত্ররাজনীতির নামে সহিংসতা দেখা গেছে। কয়েক বছর আগে একই প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপর কিছুদিন প্রশাসন কড়া নজরদারিতে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার শিথিল হয়ে পড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ না করা গেলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটতেই থাকবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ জরুরি হয়ে উঠেছে।