চীনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক উদ্বেগের মাত্রা বাড়ছে

গ্লোবাল ইকোনমি

চীনের দুর্লভ খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববাজারে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে এর প্রভাব কী হবে? বিস্তারিত পড়ুন। ছবিঃ রেউটার্স

বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি
চীন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং প্রভাবশালী দুর্লভ খনিজ রপ্তানিকারক দেশ। এই খনিজগুলো আধুনিক প্রযুক্তির রক্তধারা হিসেবে বিবেচিত—যেমন বৈদ্যুতিক গাড়ি, সোলার প্যানেল, স্মার্টফোন, চিপসেট এবং সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে এগুলোর বিকল্প নেই। চীন সম্প্রতি এসব গুরুত্বপূর্ণ খনিজের রপ্তানির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এতে বৈশ্বিক শিল্পখাত, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাত, চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক নয় বরং কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে একটি বড় বার্তা বহন করে।

কোন কোন খনিজ রপ্তানিতে চীন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে?
চীনা কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি দুর্লভ খনিজ উপাদানের রপ্তানিতে নতুন লাইসেন্সিং বিধিনিষেধ কার্যকর করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম, গ্রাফাইট এবং কিছু রেয়ার আর্থ উপাদান। এই খনিজ উপাদানগুলো আধুনিক প্রযুক্তি শিল্পের প্রধান উপাদান। চীনের এই নতুন নীতির আওতায় রপ্তানিকারকদের সরকারের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া এসব উপাদান বিদেশে পাঠানো নিষিদ্ধ। এর ফলে চীনের বাইরে এসব খনিজের সহজলভ্যতা হ্রাস পাচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরাসরি পণ্যের মূল্যে প্রতিফলিত হবে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো—এই খনিজগুলোর ওপর চরমভাবে নির্ভরশীল। চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের ফলে আধুনিক অস্ত্রপ্রস্তুতকারক থেকে শুরু করে চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সবাই গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছে। বহু কোম্পানি আগেই স্টক বাড়ানোর চেষ্টা করলেও এই রপ্তানি বিধিনিষেধ দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ব্যাহত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। একাধিক প্রযুক্তি কোম্পানি ইতোমধ্যেই বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজতে শুরু করেছে, তবে তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়া কঠিন।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার নতুন মোড়
এই পদক্ষেপ অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশলের পাল্টা জবাব। ওয়াশিংটন ইতোমধ্যে চীনের বহু প্রযুক্তি কোম্পানি, বিশেষ করে হুয়াওয়ে ও অন্যান্য ৫জি সরবরাহকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চীন এর জবাবে এখন প্রযুক্তির ভিত্তিমূল—দুর্লভ খনিজ—নিয়ন্ত্রণে এনে পাল্টা চাল দিয়েছে। এতে করে দুই পরাশক্তির মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা আরও গভীর হতে পারে, যা শুধু তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নয় বরং পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

খনিজ রপ্তানি

ছবিঃ দ্যা জাকার্তা পোস্ট

বিকল্প উৎস খোঁজার দৌড়: কতটা সম্ভব?
বিশ্বজুড়ে এখন চীনের বিকল্প খনিজ সরবরাহ উৎস খোঁজার জন্য নীতিনির্ধারক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চিলি, এবং আফ্রিকার কিছু দেশ দুর্লভ খনিজের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হলেও, সেসব স্থানে অবকাঠামো এবং প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। তদুপরি, খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং পরিবেশ-সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। ফলে চীনের বিকল্প খোঁজার এই প্রচেষ্টা তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে পারবে না।

বিশ্বব্যাপী বহু উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, যারা প্রযুক্তি পণ্য আমদানিতে চীনের ওপর নির্ভরশীল, তারা সরাসরি এই সংকটের শিকার হতে পারে। স্থানীয় উৎপাদন কমে যেতে পারে, পণ্যের দাম বাড়তে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়তে পারেন। এতে করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হতে পারে। এছাড়াও, অনেকে আশঙ্কা করছেন যে এই সংকট খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দিকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO), ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং জি-৭ সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ইতোমধ্যেই এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একে বৈশ্বিক বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা হিসেবে দেখছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই পদক্ষেপ কি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যদি ভবিষ্যতে চীন আরও খনিজ উপাদান রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়, তবে তা গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে অনেক দেশই এখন আন্তর্জাতিক খনিজ নিরাপত্তা নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে।

টেকসই সমাধান দরকার: গবেষণা ও কৌশলগত মজুতের আহ্বান
এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো টেকসই ও যৌথ উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে খনিজ পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৌশলগত খনিজ মজুত গড়ে তোলা। একই সঙ্গে, প্রয়োজন একটি বৈশ্বিক খনিজ সরবরাহ সংহত নীতি, যাতে কোনো একটি দেশের একতরফা সিদ্ধান্তে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি হুমকির মুখে না পড়ে। খনিজের ওপর অতিনির্ভরতা কমানো এবং বিকল্প প্রযুক্তি উদ্ভাবনই হতে পারে ভবিষ্যতের পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *