জন প্রশাসন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ

জন প্রশাসন অধ্যাদেশ

সচিবালয়ে জন প্রশাসন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সরকারি কর্মকর্তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তিন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার আহ্বান। ছবিঃ টিবিএস

প্রশাসনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন প্রতিবাদ

ঢাকার সচিবালয় চত্বরে আজ সকাল থেকে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্যের অবতারণা হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসন, মন্ত্রণালয় এবং দপ্তর থেকে আগত শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা একত্রিত হয়ে জন প্রশাসন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। সাদা পাঞ্জাবি ও ব্যাজ পরিহিত কর্মকর্তারা হাতে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হন এবং বিভিন্ন শ্লোগানে তাদের দাবি জানান। তাঁদের মতে, এই অধ্যাদেশ সরকার ও জনগণের মধ্যস্থতাকারী প্রশাসন কাঠামোকে নষ্ট করে ফেলবে এবং মাঠপর্যায়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জন প্রশাসন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের সংহতি ও আস্থা সংকট

জন প্রশাসন অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি প্রবল আস্থা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এই অধ্যাদেশের ফলে যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা ব্যর্থতা—even যদি তা অজান্তে বা পরিস্থিতির চাপে ঘটে—তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। এতে একজন সৎ কর্মকর্তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য ঝুঁকি নিতে সাহস পাবেন না। দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক নীতি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলার ধারা এই আইন ভেঙে দিতে পারে বলেও তাঁদের আশঙ্কা। কর্মকর্তারা বলেন, “একটি কঠোর আইন যতই উদ্দেশ্য ভালো হোক, যদি সেটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকে, তা হলে তা আস্থা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আন্দোলনের ধরন ও দাবির নৈতিক ভিত্তি

আজকের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত। কোনো রকম বিশৃঙ্খলা ছাড়াই তারা সচিবালয়ের প্রবেশপথে অবস্থান নেন এবং নির্ধারিত ব্যানারের মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। কর্মকর্তারা বলেন, তারা কোনো দলীয় স্বার্থ নিয়ে ময়দানে নামেননি বরং প্রশাসনিক গঠনতন্ত্রকে রক্ষা করতেই তাদের এই পদক্ষেপ। তারা বিশ্বাস করেন, সরকারি কর্মকর্তা মানে শুধু আদেশ পালনকারী নয়, বরং তারা জনগণের সেবক ও নীতিনির্ধারকদের বাস্তবায়নকারী অংশীদার। তাই তাদের পেশাগত মর্যাদা এবং নিরপেক্ষতা সংরক্ষিত থাকা জরুরি।

উপদেষ্টাদের কাছে স্মারকলিপি: সমাধানের পথে প্রথম পদক্ষেপ

বিক্ষোভ শেষে কর্মকর্তারা তিনজন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি প্রদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই উপদেষ্টারা হলেন প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ক উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা এবং অর্থ উপদেষ্টা। স্মারকলিপিতে অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি ছাড়াও বিকল্প প্রস্তাব ও সমাধান তুলে ধরা হয়েছে। যেমন: কর্মীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত রাখতে পৃথক অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ইউনিট গঠন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বদলে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের ওপর জোর দেওয়া এবং নিয়োগ-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা ইত্যাদি। কর্মকর্তারা আশা করছেন, উপদেষ্টারা এই বিষয়টি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবেন এবং যথাযথ ফোরামে এটি উপস্থাপন করবেন।

সচিবালয় আন্দোলন

ছবিঃ বিসনেস স্টান্ডের

আইন না কি আতঙ্ক?

এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনও কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, অনিয়ম বা অসদাচরণ দেখা দিলে তাকে দ্রুত বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা যাবে। কিন্তু কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক সময় মাঠপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাত্ক্ষণিকতা ও বাস্তবতা বিবেচনা করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে পূর্বনির্ধারিত নিয়ম বা নিখুঁততা বজায় রাখা সবসময় সম্ভব হয় না। এই অধ্যাদেশ সেই বাস্তবতাকে বিবেচনায় না এনে একতরফাভাবে কর্মকর্তাদের শাস্তিযোগ্য করে তুলেছে। এতে তাঁরা হুমকি ও আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঝুঁকি নিতে নারাজ হয়ে পড়ছেন।

পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সংহতি ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

সরকারি কর্মকর্তা সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক সংহতির সৃষ্টি হয়েছে এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশ প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ গেজেটেড অফিসার্স সমিতি, বিভাগীয় কমিশনার সভাসহ একাধিক সংগঠন একযোগে এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই অধ্যাদেশ কেবল প্রশাসনিক স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং প্রশাসনের দক্ষতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সংগঠনগুলো ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয়ভাবে বৃহত্তর কর্মসূচি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে, যদি দাবি মেনে না নেওয়া হয়।

সরকারের প্রতিক্রিয়া ও আশাবাদের আলোর রেখা

সরকারের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না দিলেও প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টাদের হাতে স্মারকলিপি পৌঁছানোর পর বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিনির্ধারক সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, একটি মধ্যপন্থী ও পারস্পরিক সম্মতিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সরকার আগ্রহী। এতে প্রশাসনের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা যাবে এবং কর্মকর্তারা আবারও আস্থার সাথে দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহী হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *