আপিল বিভাগে জামায়াতের নিবন্ধন বৈধ ঘোষণা: বাতিল হলো হাইকোর্টের রায়

আপিল বিভাগ

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হাইকোর্টের রায় বাতিল করেছে। এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। ছবিঃ প্রথম আলো ইংলিশ

আপিল বিভাগের রায়: রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মোড়

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৫ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করেছে, যেখানে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই রায়ে বলা হয়, দলটির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট আইনগত ব্যাখ্যায় ত্রুটি করেছে। আপিল বিভাগের রায় এমন সময় এসেছে যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিচ্ছে, এবং সামনে জাতীয় নির্বাচনও ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। ফলে এই সিদ্ধান্ত রাজনীতির মাঠে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।

মামলার পেছনের দীর্ঘ ইতিহাস ও আইনি প্রেক্ষাপট

২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি ও নিবন্ধন লাভ করে। এরপর ২০১৩ সালে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন) নামক একটি সংগঠন হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে, যেখানে বলা হয় যে দলটির গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাইকোর্ট এই যুক্তি মেনে নিয়ে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর দীর্ঘ এক যুগ ধরে আপিল বিভাগে মামলা ঝুলে ছিল। ২০২৫ সালে অবশেষে আপিল বিভাগ এই রায় পুনঃমূল্যায়ন করে তা বাতিল ঘোষণা করে এবং দলটির নিবন্ধনকে আবারও কার্যকর করার পথ খুলে দেয়।

আদালতের পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির বিশ্লেষণ

আপিল বিভাগ তাদের রায়ে উল্লেখ করে, হাইকোর্টের রায়ে আইনগত ব্যাখ্যায় ঘাটতি ছিল এবং সংবিধানের ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত যুক্তি উপস্থাপন করা হয়নি। আদালত মন্তব্য করে যে, সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিক ও রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক সংগঠন গঠনের অধিকার রাখে, যতক্ষণ না তারা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে কিছু ধারা থাকলেও, তা এমন পর্যায়ের নয় যে দলের নিবন্ধন বাতিল করতে হয়। ফলে, আদালত মনে করে দলটির সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছিল।

নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

রায়ের পর নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে তারা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করবেন। কমিশনের এক সদস্য জানান, “আমরা আদালতের রায় সবসময় মান্য করি। আইনি পরামর্শ অনুযায়ী আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।” এই রায় অনুযায়ী, এখন নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নাম পুনরায় নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, যদি আদালতের নির্দেশনাতে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের পথ সুগম হতে পারে।

 জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন

ছবিঃ উয়ানভি

রাজনৈতিক অঙ্গনে রায়ের প্রতিক্রিয়া

এই রায় প্রকাশের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। আওয়ামী লীগপন্থী বিশ্লেষকরা এ রায়কে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে বিতর্কিত হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে জামায়াত ও বিএনপি সংশ্লিষ্ট মহল এটিকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, জামায়াতের রাজনীতিতে পুনরায় প্রবেশ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দেশজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তবে অনেকেই মনে করছেন, একটি রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করাই প্রকৃত ন্যায়বিচারের অংশ।

জামায়াতের বক্তব্য ও রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি

রায়ের পর জামায়াতে ইসলামী এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তারা আইন ও সংবিধান মেনে চলা একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং ভবিষ্যতে আরও সক্রিয়ভাবে দেশের রাজনীতিতে অংশ নিতে চায়। দলের মহাসচিব বলেন, “আদালতের এই রায় আমাদের প্রতি আস্থা ও ন্যায়বিচারের প্রমাণ। আমরা এখন রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে আগাম নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি।” তারা আরও জানান, দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও নৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে জনমত গঠনে তারা নতুন উদ্যোগ নেবে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমীকরণ

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক মাঠে প্রত্যাবর্তন নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করতে পারে। একদিকে দলটি বিএনপির সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক পুনরায় ঝালিয়ে নিতে পারে, অন্যদিকে নিজেদের আলাদা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামপন্থী ভোট ব্যাংক ফের সংগঠিত হতে পারে, যা আগামী নির্বাচনে বড় দলগুলোর কৌশলে প্রভাব ফেলবে। সেইসাথে এটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অধিকার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *