ঢাকার বাজেট ও রেল খাতে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার লক্ষ্যে টোকিওর দ্বারে

বাংলাদেশ সরকার জাপানের কাছ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা চায়—৫০০ মিলিয়ন বাজেট সহায়তা এবং ২৫০ মিলিয়ন রেল খাত উন্নয়নের জন্য। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এই সহায়তা হতে পারে বড় চালিকা শক্তি। ছবিঃ উয়ানভি
বাজেট সহায়তার প্রেক্ষাপট ও জাতীয় প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি কঠিন অর্থনৈতিক পর্যায়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের সহায়তা গ্রহণ করে বাজেট ঘাটতি পূরণ ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সরকারের একটি কৌশলগত লক্ষ্য। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার টোকিওর কাছ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে, যার মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা এবং ২৫০ মিলিয়ন ডলার রেল খাতে ব্যবহৃত হবে। এই সহায়তা পেলে সরকারি ব্যয় নির্বাহ, সামাজিক নিরাপত্তা খাত এবং অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে।
বাংলাদেশ-জাপান অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ইতিহাস ও গুরুত্ব
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি অংশীদারিত্ব। স্বাধীনতার পর থেকেই জাপান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা (JICA) দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করে আসছে। এবার বাজেট সহায়তা এবং রেল খাত উন্নয়নে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রস্তাব সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই প্রতিফলন। এই প্রস্তাব শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং রাজনৈতিক আস্থারও একটি দৃষ্টান্ত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাপানের এই সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও দৃঢ় ও টেকসই করে তুলতে পারে।
বাজেট সহায়তার কার্যকারিতা ও প্রভাব
সরকারি বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় পরিচালনার জন্য বাজেট সহায়তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পেলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে চলতি অর্থবছরের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেক সহজ হবে। এই অর্থের একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিদ্যমান শিক্ষাখাতে উন্নয়ন প্রকল্পে। এতে করে সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যে গতি আসবে এবং রাজস্ব আয়ের চাপ কিছুটা হ্রাস পাবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহে স্থিতিশীলতা আনতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
রেল খাতে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও তার প্রভাব
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো রেলওয়ে, যা এখনো অবকাঠামো সংকট ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতায় ভুগছে। এই প্রেক্ষাপটে, টোকিওর কাছ থেকে প্রস্তাবিত ২৫০ মিলিয়ন ডলার রেল খাতের উন্নয়নের জন্য পেলে দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। এই তহবিল দিয়ে নতুন রেললাইন নির্মাণ, বিদ্যমান লাইন সংস্কার, আধুনিক ইঞ্জিন ও বগি ক্রয়, এবং ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। এর ফলে রাজধানীসহ দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোতে পরিবহন খরচ ও সময় উভয়ই কমে আসবে, যা অর্থনীতির জন্য হবে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাববিশিষ্ট।

ছবিঃ উয়ানভি
অর্থনৈতিক শর্তাবলি ও জাইকার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া
টোকিওর কাছ থেকে এ ধরনের সহায়তা পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হবে। জাইকা সাধারণত প্রকল্পের স্বচ্ছতা, টেকসইতা এবং ফলাফলনির্ভরতা বিবেচনা করে সহায়তা প্রদান করে। এই সহায়তা পাওয়ার শর্ত হিসেবে থাকতে পারে বাজেটের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, সরকারি ব্যয়ের জবাবদিহিতা, এবং পূর্বের প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যকারিতা। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যাতে এসব আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণ সহজ হয়। এই প্রক্রিয়ায় সফলতা অর্জন করলে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে উন্নয়ন সহযোগিতা পাওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হবে।
শফিকুল আলমের মন্তব্যে সরকারের পরিকল্পনা ও অগ্রগতি
অতিরিক্ত সচিব শফিকুল আলম বলেন, “আমরা জাপানের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করছি এবং তারা আমাদের প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। শিগগিরই চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।” তিনি জানান, সরকার এই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ও মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা কাঠামো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। এই সহায়তা যদি সময়মতো পাওয়া যায়, তবে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি হ্রাসের পাশাপাশি দেশের রেল খাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কূটনীতির গুরুত্ব
সরকার এই সহায়তাকে শুধু বর্তমান সংকট উত্তরণ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জন, রিজার্ভ বৃদ্ধি, মুদ্রানীতি স্থিতিশীলতা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি আরও জোরদার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। জাপানের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকলে অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররাও আস্থা পাবে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। এই উদ্যোগ শুধুমাত্র সরকারি নীতির একটি অংশ নয়, বরং দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি নির্মাণের পথপ্রদর্শক।