ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার: নীরব ঘাতক সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

ক্যান্সার লক্ষণ

ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার এক নীরব ঘাতক, যা নারীদের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রাথমিক লক্ষণ, সনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন এই প্রতিবেদন। প্রথম আলো ইংলিশ

এক নীরব ঘাতক

ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার (Ovarian Cancer) এমন এক ভয়ংকর রোগ, যা প্রায়ই “নীরব ঘাতক” হিসেবে পরিচিত। কারণ এই রোগটি শরীরের গভীরে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, কিন্তু এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে সাধারণ মানুষ তা অবহেলা করে থাকেন। পেটের সামান্য ফাঁপা ভাব, হালকা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, খাওয়ার পর পেট ভর্তি লাগা, সামান্য ব্যথা—এসব লক্ষণ যেন নিত্যদিনের স্বাভাবিক সমস্যা বলেই মনে হয়। ফলে রোগটি ধরা পড়ে অনেক দেরিতে, যখন এটি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং চিকিৎসা জটিল হয়ে ওঠে। এ কারণেই একে নীরব ঘাতক বলা হয় এবং নারীদের জন্য এটি এক গভীর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের বিস্তার

প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ নারী ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে একটি বড় অংশ রোগটি শনাক্ত হওয়ার আগেই গুরুতর অবস্থায় পৌঁছে যান। বাংলাদেশেও এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের পাশাপাশি এখন গ্রামাঞ্চলেও এই রোগ দেখা যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ বছর বয়সের পর নারীদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, তবে কম বয়সী নারীরাও সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নন। পারিবারিক ইতিহাস, জেনেটিক মিউটেশন (বিশেষ করে BRCA1 এবং BRCA2), বন্ধ্যত্ব, অতিরিক্ত ওজন, এবং দীর্ঘমেয়াদি হরমোন থেরাপি—এই সব কারণ ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক নারী এই ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জানেন না বলেই সময়মতো পরীক্ষা করান না।

প্রাথমিক লক্ষণগুলো কেন হয় অবহেলিত?

ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার শুরুতে কিছু লক্ষণ দেখা দিলেও তা অত্যন্ত সাধারণ ধরণের হয়ে থাকে, ফলে এগুলোকে গুরুতর কিছু মনে হয় না। লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—অবিরাম পেট ফাঁপা, খাবারের প্রতি অরুচি, পেটের নিচের অংশে চাপ অনুভব, হালকা ব্যথা, দ্রুত পেট ভর্তি হয়ে যাওয়া, এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ। অনেকেই এগুলোকে গ্যাস্ট্রিক বা হরমোনজনিত সমস্যা বলে ধরে নেন। কিন্তু এসব লক্ষণ যদি একটানা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় এবং প্রতিদিনের কাজে বিঘ্ন ঘটায়, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। উপেক্ষার ফলে রোগটি চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছালে তখন চিকিৎসা অনেক বেশি জটিল হয়ে যায়।

ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার শনাক্তকরণের আধুনিক পদ্ধতি

রোগটি চিহ্নিত করার জন্য বর্তমানে আধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত, পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি কিংবা ট্রান্সভ্যাজিনাল আল্ট্রাসনোগ্রাফি ব্যবহার করে ডিম্বাশয়ের আকার ও গঠন বিশ্লেষণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, CA-125 নামে একটি রক্ত পরীক্ষা জনপ্রিয়, যা রক্তে থাকা ক্যান্সার সংশ্লিষ্ট প্রোটিনের মাত্রা যাচাই করে। তবে এই পরীক্ষা সবসময় নির্ভুল নয়, কারণ অন্যান্য রোগেও এই প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি সিটি স্ক্যান, এমআরআই এবং বায়োপসি (টিস্যু নমুনা পরীক্ষা) চিকিৎসকেরা রোগ নির্ণয়ে ব্যবহার করেন। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্ত করা গেলে রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার ব্যয়ভার

ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় সাধারণত প্রথমে অস্ত্রোপচার করে ডিম্বাশয় অপসারণ করা হয়। এরপর রোগের অবস্থার ওপর নির্ভর করে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। কখনো কখনো কেমোথেরাপির সঙ্গে রেডিওথেরাপিও প্রয়োজন হয়। বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে টার্গেটেড থেরাপি বা ইমিউনোথেরাপিও প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এসব চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। অনেক নারী অর্থাভাবে সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারেন না, যার ফলে রোগ গুরুতর হয়ে ওঠে। তাই সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর উচিত এই চিকিৎসাগুলোকে অধিকতর সাশ্রয়ী করে তোলা।

প্রতিরোধই হতে পারে বাঁচার প্রধান উপায়

এই রোগ থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব নারীর পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে, তাদের বছরে অন্তত একবার গাইনোকলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পিরিয়ড অনিয়মিত হওয়া, পেটে অস্বস্তি, অথবা অজানা কারণে ওজন কমে যাওয়া—এই উপসর্গগুলো অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া দরকার। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন যেমন ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, ধূমপান পরিহার এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখলে এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে। বিয়ের বয়সে সন্তান নেওয়া এবং স্তন্যদান এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা কমিয়ে দেয় বলেও গবেষণায় দেখা গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *