ঢাকার রিকশা সংস্কৃতি: ‘রিকশার রাজা’দের অজানা সাম্রাজ্য

রিকশা সংস্কৃতি

ঢাকার রিকশা কেবল একটি বাহন নয়, এটি একটি চলমান সংস্কৃতি। এই শহরের কিছু রিকশাচালক গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সাম্রাজ্য—যাদের বলা হয় ‘রিকশার রাজা’। তাদের জীবন ও সংগ্রামের বিস্তৃত গল্প জানুন এই লেখায়। ছবিঃ আনিসুর রহমান

ঢাকার প্রাণের বাহন এবং শহরের অপরিহার্য চিত্র

ঢাকা শহরের সাথে রিকশার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রায় প্রতিটি গলিপথ ও রাস্তার মোড়ে চোখে পড়ে রঙিন, বাহারি নকশার রিকশা। ঢাকার প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত জীবনযাত্রায় রিকশা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু যাতায়াতের মাধ্যম নয়—এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়, একধরনের জনসংযোগের মাধ্যম। অনেক বিদেশি পর্যটক ঢাকায় এসেই রিকশায় চড়ে এই শহরের বিশেষ অনুভূতি নেন। এই বাহনের বাহ্যিক সৌন্দর্য যেমন মনোহারি, তেমনি এর অন্তর্নিহিত গুরুত্ব শহরের আর্থসামাজিক চিত্রকে তুলে ধরে।

ঢাকার ‘রিকশার রাজা’দের অজানা জীবনকাহিনি

রিকশা চালানো কেবল দারিদ্র্যের প্রতীক নয়—এই পেশার মধ্যেও তৈরি হয়েছে এক বিশেষ শ্রেণি, যাদের স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘রিকশার রাজা’। এরা কেবল চালক নন, অনেকেই নিজের মালিকানায় ৫ থেকে ২০টি পর্যন্ত রিকশা পরিচালনা করেন। কেউ কেউ আবার প্রতিদিন বিশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন, যা একজন চাকুরিজীবীর মাসিক বেতনের থেকেও বেশি। এদের অনেকের নিজস্ব গ্যারেজ আছে, কেউবা এলাকার নেতা হিসেবেও পরিচিত। এই চালকরা রিকশাকে শুধু বাহন হিসেবে নয়, বরং ব্যবসার অংশ হিসেবে দেখেন। তারা দক্ষতা, ভদ্রতা এবং স্মার্ট ব্যবহার দিয়ে যাত্রীদের মন জয় করে নিয়মিত ইনকাম নিশ্চিত করেন।

শহরের সৌন্দর্য আর যাত্রীর আরাম, যার পেছনে লুকিয়ে থাকে কঠোর পরিশ্রম

রিকশা যেন শহরের এক ছায়াদানকারী বৃক্ষ। কিন্তু এই বৃক্ষের পেছনে রয়েছে চালকদের নিরন্তর কষ্ট আর সংগ্রামের কাহিনি। প্রচণ্ড গরমে, বৃষ্টির ধাক্কায় বা দীর্ঘ যানজটে দাঁড়িয়ে থেকেও তারা হাসিমুখে যাত্রী পরিবহন করেন। প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা চালিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়েই চলে পরিবারের খরচ, সন্তানের পড়ালেখা, কখনো বা বৃদ্ধ পিতা-মাতার চিকিৎসা। তাদের নেই কোনো সামাজিক সুরক্ষা, পেনশন বা স্বাস্থ্যসেবা। অথচ তারাই শহরের শিরায় শিরায় প্রবাহিত কর্মচঞ্চলতা বজায় রাখেন। এমন নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন আমরা কি দিই?

রিকশার রঙে রাঙানো ঢাকার চলমান শিল্প

ঢাকার রিকশা একধরনের চলন্ত ক্যানভাস—যেখানে ফুটে ওঠে গ্রামীণ জীবন, সিনেমার গল্প, প্রেমের ছন্দ কিংবা ধর্মীয় বাণী। রিকশার পেছনের অংশে আঁকা হয় বাঘ, ঈগল, কাব্যিক লাইন কিংবা জাতীয় নেতার প্রতিকৃতি। এসব চিত্র অগণিত নিভৃত শিল্পীর হাতে আঁকা, যারা দিনের পর দিন কাঠ, টিন আর রঙ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এক অপূর্ব লোকশিল্প। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি ক্ষুদ্র শিল্পবাজারও, যেখানে রিকশা আর্টের কাঁচামাল ও প্রস্তুতকরণে নিয়োজিত শত শত মানুষ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই শিল্পটিও আধুনিকায়নের চাপে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে।

অবহেলিত অথচ অপরিহার্য একটি সামাজিক শ্রেণি

রিকশাচালকেরা সমাজে প্রায়ই অবহেলিত। তারা নিয়মিতভাবে ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি, রাজনৈতিক চাঁদাবাজি কিংবা মালিকপক্ষের শোষণের শিকার হন। বহু চালক রিকশা ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন কাজ করেন, যার বড় অংশ মালিককে দিতে হয়। তারা নিজের জন্য খুব কমই রাখতে পারেন। সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার অভাবে তারা থেকে যান দরিদ্রের কাতারে। অথচ তাদের শ্রম ছাড়া ঢাকা এক মুহূর্তও চলে না। তাই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে তাদের জন্য আলাদা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা উচিত।

রিকশা ও চালকদের ডিজিটাল রূপান্তর

বর্তমান প্রজন্মের অনেক রিকশাচালক ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ করছেন। মোবাইল ব্যাংকিং, বিকাশ, নগদ ব্যবহার করে তারা ভাড়া নিচ্ছেন। গুগল ম্যাপ দেখে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন, এমনকি কেউ কেউ অনলাইন ভিত্তিক রিকশা বুকিং সার্ভিসে যুক্ত হচ্ছেন। কিছু চালক আবার তাদের রিকশায় ব্লুটুথ স্পিকার, মোবাইল চার্জার ও ছাদ লাগিয়ে যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিত করছেন। এই পরিবর্তন শুধু রিকশাকে আধুনিক করছে না, চালকদের আর্থিক অবস্থাও উন্নত করছে। এটি রিকশার ভবিষ্যতের এক ইতিবাচক ইঙ্গিত।

শহরের যানজট কমাতে গিয়ে রিকশাকে প্রধান সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বহুবার। তবে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে বিকল্প আয়ের উৎস বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকলে, হাজারো চালক পরিবারসহ চরম বিপাকে পড়ে। উন্নয়নের নামে যদি নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবিকা হুমকিতে পড়ে, তাহলে সেই উন্নয়ন কি সত্যিই ন্যায়সঙ্গত? তাই প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিকল্পনা—যাতে আধুনিকতা এবং মানবিকতা একসাথে বজায় থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *