তুরস্কে মারমারিসে শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রাণহানি, আতঙ্কিত জনজীবন

তুরস্কের জনপ্রিয় পর্যটন নগরী মারমারিসে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে একজন নিহত হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বাড়ি, রাস্তা ও বিদ্যুৎবিভ্রাটে জনজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
আকস্মিক ভূমিকম্পে কাপলো মারমারিস শহর
তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মারমারিস হঠাৎ করেই কেঁপে উঠে ৫.৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে। স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ১২ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে, যার কম্পন পুরো শহরজুড়ে অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, মানুষজন হঠাৎ ভয় পেয়ে রাস্তায় ছুটে আসে। ঘরবাড়ি, হোটেল, দোকানপাট থেকে আতঙ্কিত মানুষ বেরিয়ে পড়ে এবং শহরে এক ধরণের বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রথম ধাক্কাটি মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও তা ছিল ভয়াবহ, কারণ এটি মাটির মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে উৎপন্ন হয়েছিল, যা ভূকম্পনকে আরও ভয়ংকর করে তোলে। শহরের নানা এলাকায় ফাটল, দেয়াল ভেঙে পড়া এবং নানা কাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও হতাহতের তথ্য
তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সয়লু এক বিবৃতিতে বলেন, “এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছে এবং আক্রান্ত এলাকাগুলিতে অনুসন্ধান ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।” তিনি আরও জানান, মৃত ব্যক্তির পরিচয় এখনও প্রকাশ করা হয়নি তবে আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিস্থিতি ঘিরে জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান এবং আশ্বস্ত করেন যে, সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রস্তুত রয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, তুরস্ক সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন ও দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ
ভূমিকম্পের ধাক্কায় মারমারিসের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়। মূলত পুরনো বিদ্যুৎ লাইন ও ট্রান্সফরমারগুলোতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল শহরের বড় একটি অংশ। বেশ কিছু ভবনের দেয়ালে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে, এবং কয়েকটি ভবন আংশিক ধসে পড়েছে বলে জানা গেছে। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা ইট-পাথরের কারণে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং অনেক এলাকা ব্লক হয়ে যায়। স্থানীয় প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে সড়ক পরিষ্কার ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালুর কাজ শুরু করে। নাগরিকদের অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়, যাতে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত না হয়। এ ছাড়া স্থানীয় স্কুল, মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেয়া হয় জরুরি ব্যবস্থা
মারমারিস মূলত একটি বিখ্যাত পর্যটন অঞ্চল হওয়ায় ভূমিকম্পের সময় সেখানে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক অবস্থান করছিলেন। ভূমিকম্পের পরপরই হোটেলগুলো দ্রুত তাদের অতিথিদের বাইরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয় এবং অনেক হোটেল তাদের অতিথিদের জন্য আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। স্থানীয় পুলিশ, উদ্ধার কর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা দল পর্যটকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিমানবন্দর ও টার্মিনাল এলাকাগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়, যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। বিদেশি দূতাবাসগুলো তাদের নাগরিকদের নিরাপদে থাকার নির্দেশনা জারি করে এবং হেল্পলাইন চালু করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে।

ছবিঃ জাগোনিয়াস ২ ৪
ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও পরবর্তী ঝুঁকির পূর্বাভাস
তুরস্কের ভূতাত্ত্বিক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মারমারিস উপকূলবর্তী অঞ্চলের ঠিক ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত অগভীর ভূকম্পন সাধারণত তীব্রভাবে অনুভূত হয় এবং ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও বেশি থাকে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় আরও আফটারশক হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ৪.১ ও ৩.৮ মাত্রার দুটি ছোট আফটারশক অনুভূত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইনস্টিটিউট। সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে, তারা যেন খোলা জায়গায় অবস্থান করে এবং ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ও সুরক্ষা বিষয়ক সরকারি নির্দেশিকা মেনে চলে।
অতীতের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনলো এই ভূমিকম্প
তুরস্ক বারবার ভূমিকম্পের কবলে পড়েছে এবং এই ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আবারও ১৯৯৯ সালের ইজমিত ভূমিকম্প বা ২০২৩ সালের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ কম্পনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনলো। জনগণের মনে এক ধরণের ভয় কাজ করতে শুরু করেছে, বিশেষ করে যেসব পরিবার ইতিপূর্বে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মানুষ নিরাপত্তার অভাবে ঘরের বাইরে, খোলা মাঠ কিংবা গাড়ির ভেতরে রাত কাটানোর প্রস্তুতি নেয়। নির্মাণ খাতে দুর্বল কাঠামো এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে তীব্র সমালোচনা উঠে এসেছে বিভিন্ন মহলে। সাধারণ জনগণ চাইছে, এখন থেকে ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নীতি বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ হোক।
তৎপরতা চালায় উদ্ধার ও স্বেচ্ছাসেবী দল
ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে তুরস্ক সরকারের জরুরি ব্যবস্থাপনা সংস্থা AFAD দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সম্মিলিতভাবে উদ্ধার ও ত্রাণকাজে অংশ নেয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় টেন্ট, খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জরুরি ইউনিট খুলে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যাতে রক্তদান করতে পারে সে লক্ষ্যে রক্ত সংগ্রহ ক্যাম্প চালু করা হয়। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে মানবিকতা ও সংহতির চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করে।
ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা ও প্রস্তুতির শিক্ষা
এই ভূমিকম্পটি তুরস্কের জন্য একটি বড় শিক্ষা হিসেবে সামনে এসেছে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখন কীভাবে আঘাত হানে তা কেউ জানে না, কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এর ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। ভবিষ্যতের জন্য তুরস্ককে আরও আধুনিক ভূমিকম্প সতর্কবার্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য স্কুল, কলেজ এবং স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। ভবন নির্মাণে কোড মেনে চলা, জরুরি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা, এবং সঠিক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে তুরস্ক একটি দুর্যোগ-সহনশীল জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। জনসচেতনতা, সরকারী তৎপরতা ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের সমন্বয়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।