ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ভিয়েতনামে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিকল্প ‘তৃতীয় পথ’ প্রস্তাব

তৃতীয় পথ কূটনীতি

ভিয়েতনাম সফরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাবের বাইরে একটি ‘তৃতীয় পথ’ প্রস্তাব করলেন। জানুন এ সফরের কূটনৈতিক তাৎপর্য ও ভিয়েতনামের ভূরাজনৈতিক অবস্থান। ছবিঃ ফ্রান্সে ২ ৪

ফ্রান্সের কূটনৈতিক লক্ষ্য ও ভিয়েতনাম সফরের প্রেক্ষাপট

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সফরে ভিয়েতনামে পৌঁছেছেন, যার মূল উদ্দেশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে ফ্রান্সের অবস্থান জোরদার করা। এই সফরটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। ম্যাক্রোঁ এ সফরের মাধ্যমে ইউরোপের একটি বিকল্প কূটনৈতিক রূপরেখা উপস্থাপন করতে চান—যেটি ‘তৃতীয় পথ’ নামে অভিহিত হচ্ছে।

‘তৃতীয় পথ’ ধারণাটি এমন একটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা কোনো বৃহৎ শক্তির প্রভাবমুক্ত থেকে পারস্পরিক স্বার্থে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। ম্যাক্রোঁর মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেছে নেওয়ার পরিবর্তে ইউরোপের সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। এই ধারণা ভিয়েতনামের মতো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যারা দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।

ভিয়েতনামের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং গুরুত্ব

ভিয়েতনাম দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি কৌশলগত দেশ, যেটি চীনের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখে। ফ্রান্সের সঙ্গে এর ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে উপনিবেশ আমলের সময় থেকে। ম্যাক্রোঁ এই সফরে সেই সম্পর্ককে আধুনিক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে রূপান্তর করতে চান। ভিয়েতনামের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সক্ষমতা ফ্রান্সকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করতে পারে।

বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গ

ম্যাক্রোঁর সফরে বাণিজ্যিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফরাসি ও ভিয়েতনামী কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে পরিবহন, অবকাঠামো, এবং উচ্চ প্রযুক্তির খাতে। ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ভিয়েতনামকে ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের একটি দরজা হিসেবেও বিবেচনা করছে। একই সঙ্গে ফরাসি বিনিয়োগকারীরাও ভিয়েতনামের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী।

ম্যাক্রোঁর সফরে প্রতিরক্ষা খাতেও আলোচনা হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী ভূমিকাকে ঘিরে ভিয়েতনামের উদ্বেগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ফ্রান্সের সঙ্গে সমুদ্র নিরাপত্তা, যৌথ মহড়া এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। যদিও ফ্রান্স ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় সামরিক জোটবদ্ধতার প্রতিশ্রুতি দেয়নি, তবে কৌশলগত সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে।

সাংস্কৃতিক বন্ধনের নতুন রূপ

সফরে শুধু কূটনীতি নয়, ফ্রান্স ও ভিয়েতনামের সাংস্কৃতিক সম্পর্ককেও নতুন করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ম্যাক্রোঁ হ্যানয়ের একটি ফরাসি স্কুল ও ঐতিহাসিক স্থাপনাও পরিদর্শন করেন, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা, ছাত্র বিনিময় কর্মসূচি এবং ফরাসি ভাষা শিক্ষার বিস্তার এ সফরের অন্যতম দিক।

ম্যাক্রোঁর এই সফর তার বৃহত্তর ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’র অংশ, যার মাধ্যমে ফ্রান্স চায় এ অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রভাব বৃদ্ধি করতে। ফরাসি নীতিনির্ধারকদের মতে, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্য না মেনে ইউরোপীয় একটি কণ্ঠ এ অঞ্চলে দরকার, এবং ফ্রান্স সেই ভূমিকাটিই পালন করতে চায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে ফ্রান্স আরও নতুন কৌশল নিয়েও কাজ করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *