নতুন ফ্যাসিবাদের লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে: মন্তব্য আনু মুহাম্মদের

বাংলাদেশ রাজনীতি

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সতর্ক করেছেন যে বাংলাদেশে নতুন ধরণের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রকট হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, রাজনৈতিক দমননীতি ও নাগরিক অধিকারের সংকোচন দেশকে একটি বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছে। ছবিঃ শুভ্র কান্দি দাস

উদ্বেগ প্রকাশ আনু মুহাম্মদের

বাংলাদেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সম্প্রতি এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “বাংলাদেশে নতুন ফ্যাসিবাদের লক্ষণ শোনা যাচ্ছে।” তার মতে, এ ধরণের ফ্যাসিবাদ আগের মতো সামরিক পোশাকে নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার আড়ালে কার্যকর হচ্ছে। রাজনৈতিক সহনশীলতার ঘাটতি, একমুখী তথ্যপ্রবাহ, ভিন্নমত দমন এবং জনগণের চিন্তাভাবনায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য অশনিসংকেত। এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

মতপ্রকাশের অধিকার সংকুচিত হচ্ছে

আনু মুহাম্মদের বক্তব্য অনুযায়ী, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আজ চরম হুমকির মুখে। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সামান্য সমালোচনাও এখন অপরাধে পরিণত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করে যেসব নাগরিক সরকারবিরোধী মত দেন, তাদের ওপর হুমকি, নজরদারি এবং কখনো কখনো গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হচ্ছে। সাংবাদিকতা পেশাটি আজকাল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যেখানে সত্য প্রকাশ করাই একপ্রকার বিপদ ডেকে আনার সামিল। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বাধীনতা নয়, বরং একটি মুক্ত সমাজের মূল ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত

গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও বর্তমান বাংলাদেশে সেটি বড় ধরনের সংকটে রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হলেও সমালোচনামূলক বা স্বাধীন মিডিয়াগুলোর ওপর রয়েছে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও চাপ। অনেক সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে হয়রানি, বিজ্ঞাপন বন্ধ, অথবা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেওয়া হয়, যার ফলে তারা নিজেদের স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। এমনকি সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণ (self-censorship) একটি ভয়াবহ বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন নতুন নিয়মে

আনু মুহাম্মদের মতে, বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার কৌশল আগের চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী ও পরিশীলিত হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় বিরোধী দলের প্রার্থী, কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং প্রতিবাদী সমাবেশে বাধা দেওয়ার ঘটনা এখন নিয়মিত। এককভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে সরকার বিরোধী মতকে পুরোপুরি দমন করে চলেছে। এর ফলে দেশের রাজনীতি এখন কার্যত একদলীয় কাঠামোর দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়।

 আনু মুহাম্মদ

ছবিঃ আলাল ও দুলাল

শিক্ষাঙ্গনে দমননীতি ও ছাত্র রাজনীতির সংকট

দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতেও একই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ দেখা যাচ্ছে বলে জানান আনু মুহাম্মদ। তার মতে, ছাত্রদের সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এখন হুমকির মুখে। যারা ভিন্নমত পোষণ করে কিংবা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়, তাদেরকে হয়রানি বা বহিষ্কারের শিকার হতে হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি, যা এক সময় রাজনৈতিক চেতনা ও সামাজিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এখন তা নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর আধিপত্যে চলে গেছে। ফলে চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং নেতৃত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিয়মিত চিত্র

আনু মুহাম্মদ বলেন, আজকে দেশের সাধারণ মানুষও নিরাপদ নয়। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার অংশ হয়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনার বিচার হয় না, বরং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তা ধামাচাপা পড়ে যায়। এটি একটি ফ্যাসিবাদী সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে জনগণকে নিশ্চুপ করে রাখা হয়।

অর্থনৈতিক নীতিতে গণতন্ত্রহীনতা

অর্থনৈতিক দিক থেকেও দেশে গণতন্ত্রহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে জানান আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ, ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি এবং দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। বাজেট প্রণয়নে জনস্বার্থ নয়, বরং মুনাফাভিত্তিক নীতিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে, এবং ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আরও তীব্র হচ্ছে। অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে একটি শ্রেণি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠছে, যা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে তুলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *