নদী দখলের ভয়াবহতা: বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের নীরব ঘাতক

পরিবেশ বিপর্যয়

বাংলাদেশে নদী দখলের বিস্তার দিন দিন বেড়েই চলছে। এই আর্টিকেলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিভাবে অবৈধ দখল পরিবেশ, জীবনধারা ও জলবায়ুকে চরম হুমকির মুখে ফেলছে এবং সমাধানের কার্যকর পথ কী হতে পারে। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

নদী দখলের বাস্তবতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও, আজ সেই নদীগুলোই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী দখলের ঘটনা এতটাই বেড়ে গেছে যে, অনেক নদী আজ বিলীন হওয়ার পথে। রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদী যেমন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা—এসব নদীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে মার্কেট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত আবাসন। এ ধরনের অবৈধ স্থাপনা নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করছে। এমনকি নদীর গভীরতা কমে গিয়ে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে, যা দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনা যেন দিনে দিনে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে, কারণ অপরাধীরা প্রায়শই অদৃশ্য রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে যায়।

প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও আইনের দুর্বল প্রয়োগ

নদী রক্ষার জন্য আইন থাকলেও, তার প্রয়োগে রয়েছে চরম দুর্বলতা। ‘নদী রক্ষা আইন ২০১৩’ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইনসহ একাধিক আইনি কাঠামো থাকলেও বাস্তবায়ন চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা এককালীন এবং স্থায়ী সমাধান আনে না। স্থানীয় প্রশাসনের অনেক সদস্যই দখলদারদের সঙ্গে গোপন আঁতাতে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে অভিযোগ করেও সাধারণ মানুষ ন্যায্য বিচার পান না। মাঝে মাঝে দখলদারদের নাম প্রকাশ পেলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ হয় না। এই আইনি নিষ্ক্রিয়তা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই দখলকারীরা আগ্রাসী হয়ে উঠছে এবং নদী ধ্বংস করে তুলছে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব

নদী কেবল পানি প্রবাহের উৎস নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী দখলের ফলে প্রাণিকূল এবং জলজ উদ্ভিদ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। মাছের প্রজননস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। পাখির অভয়াশ্রম হারাচ্ছে তাদের নিরাপদ বাসস্থান। নদী পাড়ে থাকা গাছপালা কেটে ফেলার কারণে মাটি ক্ষয় হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক ছায়াঘেরা অঞ্চলগুলো রূপ নিচ্ছে কংক্রিট জঙ্গলে। পাশাপাশি, নদীর পানি দূষিত হয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, ফলে কৃষকেরাও বিপাকে পড়ছে। এসব ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদে দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে, যার ফল ভোগ করতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

নদী দখলের কারণে বন্যা ও ভাঙন সমস্যা

নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বর্ষাকালে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হতে পারে না, ফলে নিম্নাঞ্চলগুলোতে হঠাৎ করে পানি জমে গিয়ে তৈরি হয় আকস্মিক বন্যা। আবার, নদী সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণে পানি প্রবাহের গতি বাড়ে এবং তীরবর্তী এলাকার ভূমি ভেঙে গিয়ে নদীভাঙন তীব্রতর হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত দশ বছরে নদীভাঙনের কারণে প্রায় তিন লাখ মানুষ বসতভিটা হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এরা অনেকেই শহরের বস্তিতে আশ্রয় নেয়, ফলে শহর অঞ্চলেও জনসংখ্যার চাপ বাড়ে। এই প্রক্রিয়া শুধু সামাজিক বৈষম্যই বাড়ায় না, বরং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও হয়। অথচ সময়মতো নদী দখল রোধ করা গেলে এই দুর্যোগগুলো অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো।

নদী রক্ষা

ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

জনসচেতনতার অভাব ও মিডিয়ার সীমিত প্রচারণা

নদী রক্ষায় সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে জনসচেতনতায় ঘাটতি। অনেকেই এখনও বুঝে উঠতে পারেন না নদী সংরক্ষণের গুরুত্ব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নদী দখলকে ‘কর্তৃপক্ষের ব্যাপার’ মনে করে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যদিও মিডিয়া মাঝে মাঝে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তবুও বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক প্রচার কার্যক্রম অনেকটাই অনুপস্থিত। টেলিভিশন, পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে নদী রক্ষা নিয়ে আলোচনার পরিমাণ অপ্রতুল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ক প্রচারণা এবং প্রচলিত আন্দোলন সীমিত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। তাই নদী রক্ষায় মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষকে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

নদী রক্ষায় নাগরিক সমাজ ও স্বেচ্ছাসেবকদের করণীয়

প্রশাসনের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং শিক্ষার্থীদের সচেতন ও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। নদীর সঠিক অবস্থান এবং দখলের ধরন নির্ণয় করে প্রতিবেদন তৈরি করে প্রশাসনে দাখিল করা যেতে পারে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দখলকারীদের নাম প্রকাশ ও তাদের সামাজিকভাবে বয়কটের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ‘নদীবন্ধু ক্লাব’ গড়ে তোলা যেতে পারে, যারা নিয়মিত নদী সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এভাবে তৃণমূল থেকে নদী রক্ষার সংস্কৃতি গড়ে উঠলে পরিবর্তন সম্ভব।

আইনি সংস্কার ও কঠোর শাস্তির প্রয়োজনীয়তা

বর্তমান আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দখলকারীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। তাই আইনকে আরও শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ করতে হবে। নদী দখলকারীদের ছবি ও নাম প্রকাশ করে জাতীয়ভাবে তালিকা প্রকাশ করা যেতে পারে। এছাড়া দখলদারদের বিরুদ্ধে জরিমানা আরোপ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং কারাদণ্ড দেওয়ার মতো শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল দখল উচ্ছেদ নয়, দখলকারীদের অর্থে পুনরুদ্ধার করা নদী সংস্কার করাও উচিত। নদী রক্ষা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করলে, এটি একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত হতে পারে অন্যান্য অপরাধীদের জন্য।

টেকসই সমাধানের দিকনির্দেশনা

নদী সংরক্ষণের জন্য চাই সমন্বিত ও টেকসই কর্মপরিকল্পনা। শুধু দখল উচ্ছেদ নয়, প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নদী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার এবং নিয়মিত মনিটরিং রিপোর্ট। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে গণশুনানি পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে, যেখানে নদী রক্ষায় জনগণের অভিমত গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি, নদীকে ঘিরে পরিকল্পিত পুনর্বাসন এবং পর্যটন গড়ে তুলে একে অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত করাও সম্ভব। সরকার, প্রশাসন ও জনগণ একযোগে কাজ করলে একদিন হয়তো আমরা নদীমাতৃক বাংলাদেশের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *