ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ‘নাপাম গার্ল’ ছবির কৃতিত্ব স্থগিত করল

নাপাম গার্ল

বিশ্ববিখ্যাত ‘নাপাম গার্ল’ ছবির কৃতিত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো। এই সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ, এবং এর প্রভাব কী হতে পারে—জানুন বিস্তারিত এই প্রতিবেদন থেকে। ছবিঃ সংগ্রহ

একটি ছবিতে বন্দি ইতিহাসের তীব্রতা

‘নাপাম গার্ল’ ছবিটি বিশ্ব ইতিহাসে এমন এক মুহূর্ত ধারণ করে যা আজও মানবতার বিবেককে নাড়া দেয়। ১৯৭২ সালের ৮ জুন, ভিয়েতনামের ত্রাং বাঁই গ্রামের উপর মার্কিন বাহিনী যখন নেপালম বোমা বর্ষণ করে, তখন সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি শিশু মেয়ে—কিম ফুক। তার পোড়া শরীর, মুখের আতঙ্ক, নগ্নতায় আচ্ছন্ন জীবনবাঁচানো দৌড়—এসব মিলে ছবিটি এমন এক প্রতীক হয়ে ওঠে, যা যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা আর বেদনার বাস্তব সাক্ষ্য দেয়। ছবিটি শুধু একটি সংবাদ ছিল না; এটি ছিল এক নির্দয় বাস্তবতার দলিল, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে নয়, শিশুর চোখেও কী ভয়াবহ চিত্র একে দেয়।

নিক উটের ক্যামেরা ও মানবিকতা: ছবির আড়ালের কাহিনি

নিক উট, যিনি তখন Associated Press-এর একজন তরুণ ফটোসাংবাদিক ছিলেন, তিনি শুধু এই অসাধারণ ছবি তুলেই থেমে যাননি। বরং তার ক্যামেরার লেন্সের বাইরে যে মানবিকতা ছিল, সেটিই তাকে আলাদা করে তুলেছে। কিম ফুক যখন দগ্ধ শরীরে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় দৌঁড়াচ্ছিল, নিক উট ছবি তোলার পর তাকে দ্রুত গাড়িতে তুলে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে সেই ছবিই তাকে পুলিৎজার পুরস্কার এনে দেয়, আর যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক বানিয়ে তোলে। অনেকেই মনে করেন, সাংবাদিকতা কেবল ঘটনাকে তুলে ধরা নয়, বরং তাতে নৈতিকতা ও সহানুভূতির ছাপ থাকাও অত্যন্ত জরুরি, আর এই কাজটি নিঃসন্দেহে নিক উট অনন্যভাবে করে দেখিয়েছেন।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’র বিতর্কিত সিদ্ধান্ত: স্থগিত কৃতিত্ব

২০২৫ সালে, হঠাৎ করেই ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো কর্তৃপক্ষ ‘নাপাম গার্ল’ ছবিটির কৃতিত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দেয়, যা বিশ্বব্যাপী ফটোজার্নালিজম জগতে আলোড়ন তোলে। তাদের মতে, ছবিটির উৎস, পরিবেশ এবং ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে নতুন করে কিছু প্রশ্ন উঠেছে যা পুনরায় পর্যালোচনা প্রয়োজন। যদিও এ সিদ্ধান্তের পেছনে নির্দিষ্ট কোনো অসঙ্গতি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি, তবে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছবিটি নিয়ে সকল কৃতিত্ব স্থগিত থাকবে। এই ঘোষণা অনেকের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত এবং অনেকটা হতাশাজনক, বিশেষত যখন এটি ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ছবি হিসেবে বিবেচিত।

বিতর্কের নেপথ্যে সম্ভাব্য কারণসমূহ

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’র এই সিদ্ধান্তের পেছনে বিভিন্ন কারণের জল্পনা চলছে। কিছু গবেষক দাবি করেছেন, ছবির সময়কাল, এর ব্যাকগ্রাউন্ড ও ঘটনাস্থলের বর্ণনায় সাম্প্রতিককালে কিছু অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে। আবার অনেকে বলছেন, কিম ফুক-এর সম্মতি ছাড়া ছবিটি বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে, যা নৈতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এ ছাড়া, ছবিটি এত বছর পর হঠাৎ এমন বিতর্কের মুখে পড়া, প্রমাণ করে যে ইতিহাস কখনোই চূড়ান্ত নয়—নতুন প্রমাণ ও উপলব্ধি সবসময় পুরনো সত্যকে পুনরায় পর্যালোচনার মুখে ফেলে দিতে পারে।

কিম ফুকের আত্মকথা ও প্রতিক্রিয়া

‘নাপাম গার্ল’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র কিম ফুক আজ একজন আন্তর্জাতিক মানবতা ও শান্তির দূত। তিনি নিজেই একাধিকবার বলেছেন, এই ছবি তার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্ত হলেও, তা বিশ্বকে যুদ্ধের নির্মমতা বোঝাতে সাহায্য করেছে। তিনি চান তার গল্প মানুষকে শিক্ষা দিক, তবে সেই শিক্ষা যেন তার সম্মান বজায় রেখেই হয়। ছবিটি ব্যবহার ও ক্রেডিট নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে তার পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না এলেও, তিনি অতীতে স্পষ্ট করেছেন—অনুমতি ছাড়া ছবির ব্যবহার তিনি সমর্থন করেন না। এই বক্তব্য বর্তমান বিতর্কে অনেক ওজনদার হয়ে উঠছে।

‘নাপাম গার্ল’ ছবিকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকতা জগত আবার নতুন করে ভাবছে—সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা আর নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে সীমানা কোথায়? একজন সাংবাদিক কি শুধুই ঘটনা ক্যাপচার করবেন, নাকি সেই ঘটনার সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রভাবও বিবেচনায় আনবেন? এই বিতর্ক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ছবির পেছনে মানুষ থাকে, তাদের জীবনের গল্প থাকে। তাই ইতিহাস রক্ষার পাশাপাশি মানবিকতার মর্যাদা রক্ষা করাও ফটোজার্নালিজমের অন্যতম দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *