নিঝুম দ্বীপে জোয়ারভাটা জলে চিত্রল হরিণের মনোমুগ্ধকর বিচরণ

নিঝুম দ্বীপের জোয়ারভাটা জলে চিত্রল হরিণের আবিষ্কৃত এক দুর্লভ মুহূর্ত প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে। উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এই দৃশ্য নতুন আশার বার্তা বহন করে। ছবিঃ প্রথমআলো ইংলিশ / এমডি: জামশেদ
প্রকৃতির এক নিঃশব্দ স্বর্গভূমি
নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি স্বল্প পরিচিত, অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ। এই দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর জোয়ার-ভাটার ধারায় তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে। এখানে বালুকাময় চর, লোনা পানির জলাভূমি এবং বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন মিলিত হয়ে গড়ে তুলেছে এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ। দ্বীপটির শান্ত নিসর্গ ও নির্জনতা শুধু পর্যটকদের নয়, বরং বন্যপ্রাণীদের জন্যও এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই পরিবেশে বহু বছর ধরে বসবাস করছে চিত্রল হরিণ, যা আজও দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যের অন্যতম প্রতীক।
নিঝুম দ্বীপে প্রকৃতির বিরল নাট্যমঞ্চ
সম্প্রতি একটি অসাধারণ মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি হয়েছে নিঝুম দ্বীপে। একটি চিত্রল হরিণকে দেখা গেছে দ্বীপের লবণাক্ত জোয়ারের জলে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে। সাধারণত এই প্রজাতির হরিণ গভীর বনের ঘাসজ মাঠে দেখা যায়, অথচ এভাবে প্রকাশ্য জলে তাদের উপস্থিতি সচরাচর দেখা যায় না। এ দৃশ্য ছিল নিছক অবাক করা এবং দৃষ্টিনন্দন। স্থানীয় একদল আলোকচিত্রীর তৎপরতায় এই মুহূর্তটি ধরা পড়েছে, যা পরে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই হরিণের এই ব্যতিক্রমী আচরণ নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সাক্ষ্য বহন করে এবং এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব আরও একবার তুলে ধরে।
বনাঞ্চলের সৌন্দর্য ও সংবেদনশীল প্রাণী
চিত্রল হরিণ, যাকে ইংরেজিতে Spotted Deer বা Axis Deer বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার একটি সুপরিচিত ও সংবেদনশীল প্রাণী। এর গায়ে ছোট ছোট সাদা ফোঁটা ও বাদামি রঙের পালক এদের পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলে এদের প্রধানত দেখা যায়। তারা সাধারণত দলবদ্ধভাবে চলে এবং শান্ত পরিবেশে বসবাস করতে চায়। এদের প্রধান খাদ্য তৃণ, গাছের পাতা, ফলমূল ও লতাগুল্ম। নিঝুম দ্বীপে এই হরিণের দেখা পাওয়া প্রমাণ করে দ্বীপটি এখনো প্রাকৃতিকভাবে জীবিত এবং প্রাণীদের জন্য বসবাসযোগ্য। তবে এই প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য সরবরাহ এবং মানব হস্তক্ষেপের সীমাবদ্ধতা।
নিঝুম দ্বীপের প্রাণীকূল ও প্রাকৃতিক সম্পদ
নিঝুম দ্বীপ শুধু চিত্রল হরিণের আবাসস্থল নয়, বরং এটি নানা প্রজাতির প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। দ্বীপটিতে চিত্রল হরিণ ছাড়াও আছে শিয়াল, বন বিড়াল, বানর, নানা প্রজাতির পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও বিভিন্ন জলজ জীব। এটি বাংলাদেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বনবিভাগের উদ্যোগে এই অঞ্চলে নানা সময়ে বৃক্ষরোপণ ও ম্যানগ্রোভ বন সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যাতে এখানকার বাস্তুতন্ত্র টিকে থাকে। তবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ছবিঃ ট্রাভেল মেটা বাংলাদেশ
পরিবেশগত গুরুত্ব ও বর্তমান হুমকিসমূহ
নিঝুম দ্বীপ শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষার অন্যতম স্তম্ভ। এই দ্বীপ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় মূল ভূখণ্ডকে আংশিকভাবে রক্ষা করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ দ্বীপের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে পর্যটনের অপরিকল্পিত বিকাশ ও স্থানীয় মানুষের নির্ভরতা দ্বীপটির প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। এই দ্বীপের স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষা করা শুধু চিত্রল হরিণের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য জরুরি।
নিঝুম দ্বীপে পর্যটনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে শীতকালে হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভিড় করেন নির্জন সৈকত ও জীববৈচিত্র্যের টানে। কিন্তু অপরিকল্পিত পর্যটন ও অনিয়ন্ত্রিত যাতায়াত প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অনেক সময় পর্যটকদের অসচেতন আচরণ যেমন শব্দদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ ও বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তাই দায়িত্বশীল পর্যটন নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকদের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় গাইডদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত সফরের ব্যবস্থা করলে দ্বীপের পরিবেশ ও প্রাণীকূল উভয়ই লাভবান হবে।
সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
চিত্রল হরিণের এই জোয়ারভাটা জলে বিচরণ নিঝুম দ্বীপকে নতুন করে সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। এই দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি এখনও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব যদি আমরা যথাযথভাবে তার যত্ন নেই। সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশবাদী সংস্থা এবং গবেষকদের একযোগে কাজ করা দরকার। দ্বীপটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি’ হিসেবে ঘোষণা করা গেলে সেখানে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। একই সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের জীবিকা ও প্রকৃতির মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করে নিঝুম দ্বীপকে একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব।