বিক্ষোভের মধ্যেই সরকার জারি করলো পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স

সরকার নতুন পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স জারি করেছে যা সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও শৃঙ্খলার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। এই সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক, বিক্ষোভ ও আইনি প্রশ্ন। ছবিঃ বাংলা ট্রিবিউন
অর্ডিন্যান্স জারির পটভূমি
সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে যখন উত্তেজনা বিরাজ করছে, তখনই সরকার হঠাৎ করে “পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স” জারি করে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ব পালনে নতুন কিছু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সরকার বলছে, এটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নেওয়া হয়েছে। তবে নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ প্রশাসনের কণ্ঠরোধের একটি কৌশল মাত্র।
অর্ডিন্যান্সের মূল বিষয়বস্তু
নতুন জারি হওয়া পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা অনুমতি ছাড়া সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পারবেন না, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। কর্মকর্তাদের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং কর্মস্থলে শৃঙ্খলা রক্ষায় কয়েকটি নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে দ্রুত বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। বদলি, পদোন্নতি ও বরখাস্তের ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এই নিয়মগুলো কতটা নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ হবে, সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশ্লেষক।
নাগরিক সমাজ ও কর্মজীবীদের প্রতিক্রিয়া
এই অর্ডিন্যান্স জারির পরপরই দেশজুড়ে সাধারণ জনগণ, সরকারি চাকরিজীবী এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও সমালোচনা দেখা দেয়। তাদের অনেকেই বলছেন, এই ধরনের আইন সরকারী কর্মচারীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করবে এবং তাদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইন রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। কর্মজীবীদের একাংশ আশঙ্কা করছে, নতুন নিয়মের অপব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়া হতে পারে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।
বিরোধী দলগুলোর অবস্থান
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সরাসরি “গণতন্ত্র বিরোধী” পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের মতে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে আগামী নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতেই এই আইন জারি করা হয়েছে। সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই রাষ্ট্রপতির আদেশে অর্ডিন্যান্স জারি করাকে তারা স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছে। এরই মধ্যে প্রধান প্রধান বিরোধী দলগুলো ঢাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে এবং দেশব্যাপী প্রচার অভিযান শুরু করেছে এই অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবিতে।

সরকারের ব্যাখ্যা ও যুক্তি
সরকার বলছে, এই পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স কোনোভাবেই মৌলিক অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং এটি সরকারি খাতের কর্মদক্ষতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়বদ্ধতা তৈরি হবে এবং সেবা প্রদানের মান উন্নত হবে। পূর্ববর্তী বিধিমালার অস্পষ্টতা ও পুরনো কাঠামোকে সরিয়ে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করার প্রয়াস বলা হচ্ছে এই উদ্যোগকে। তবে সরকার এখন পর্যন্ত বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়নি।
আন্দোলন ও বিক্ষোভ পরিস্থিতি
অর্ডিন্যান্স জারির প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি চাকরিজীবীদের নানা সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। কোথাও শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, আবার কোথাও পুলিশি বাধার মুখে বিক্ষোভকারীরা সংঘর্ষেও জড়িয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তারা বলছে, এই অর্ডিন্যান্স বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। এতে করে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আইনি বিশ্লেষণ ও মানবাধিকার প্রশ্ন
আইনজীবীরা বলছেন, এই অর্ডিন্যান্সের কিছু ধারা সরাসরি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই অর্ডিন্যান্স একধরনের কণ্ঠরোধ নীতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অনেকেই বলছেন, এটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এই বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।