সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার | পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স পর্যালোচনার আশ্বাস

পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স পর্যালোচনার সরকারি আশ্বাসের পর সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। আন্দোলনের মূল দাবি ছিল অর্ডিন্যান্সের বিতর্কিত ধারা বাতিল ও সংশোধন। ছবিঃ সংগ্রহ
আন্দোলনের পটভূমি
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে সম্প্রতি উত্তেজনা তৈরি হয় একটি নতুন অর্ডিন্যান্স ঘিরে। বিতর্কিত পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্স কার্যকর হওয়ার পর সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়। এই আইনের ফলে দুর্নীতির অভিযোগ বা অন্য কোনো গুরুতর অনিয়মে অভিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন হয়, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের কর্মক্ষেত্র থেকে বের হয়ে রাজধানীর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা প্রশাসনিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ
সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং আন্দোলনকারী নেতারা অংশ নেন। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল অর্ডিন্যান্সের ধারা গুলো পুনর্বিবেচনা করে একটি ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা নেওয়া। সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয়, একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা হবে, যারা এই অর্ডিন্যান্সের প্রতিটি ধারা খতিয়ে দেখবে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের সুপারিশ করবে। এই আশ্বাস আন্দোলনকারীদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করে এবং তারা সাময়িকভাবে কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে সম্মত হন।
আন্দোলন প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
আলোচনার ফলাফলের ভিত্তিতে আন্দোলনকারী সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয় যে, তারা আপাতত সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার করছেন। তাদের মতে, সরকার যখন নীতিগতভাবে অর্ডিন্যান্স পর্যালোচনার আশ্বাস দিয়েছে এবং স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তখন তারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রক্রিয়ার দিকে নজর রাখতে চান। তবে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, যদি সময়মতো অগ্রগতি না হয় বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়, তবে আন্দোলন আবারও সক্রিয়ভাবে শুরু হবে এবং বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে।
পাবলিক সার্ভিস অর্ডিন্যান্সের বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো এর ধারা ৫(১), যেখানে বলা হয়েছে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত বা আইনগত ব্যবস্থা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে। এই বিধানটি কার্যত একটি সুরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা দুর্নীতিকে আড়াল করে রাখে এবং জবাবদিহিতা হ্রাস করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা প্রশাসনিক সংস্কারের পরিপন্থী এবং এতে প্রশাসনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমে যায়। মানবাধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এর বিরোধিতা করে এসেছে।

ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
প্রশাসনের ব্যাখ্যা ও প্রতিক্রিয়া
সরকারি প্রশাসন এই অর্ডিন্যান্সের পক্ষ নিয়ে বলছে, এটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অহেতুক হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছিল। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ আনা হয়। তাই অনুমতির বাধ্যবাধকতা ছিল একটি নিরাপত্তার ব্যবস্থা। তবে সরকার এই বাস্তবতা মেনেই বলেছে, বর্তমানে জনগণের স্বার্থ এবং দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে অর্ডিন্যান্সটি পর্যালোচনার আওতায় আনা হবে এবং সংশোধন সম্ভব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনিক কাঠামোতে জবাবদিহিতার অভাব এবং অন্ধ সুরক্ষা দেওয়ার প্রবণতা দেশের সার্বিক শাসন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিরোধী দলগুলো একে প্রশাসনের মধ্যকার দুর্নীতি রক্ষা করার একটি চেষ্টা বলেই মনে করছে। তাদের মতে, এই অর্ডিন্যান্স যতদিন বলবৎ থাকবে, ততদিন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তবে সরকারের প্রতিশ্রুতি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি হতে পারে প্রশাসনিক সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও আন্দোলনের দিকনির্দেশনা
আন্দোলন আপাতত স্থগিত হলেও আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো খুবই সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, তারা সরকারের প্রতিশ্রুতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। কমিটি গঠনের গতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বচ্ছতা, অর্ডিন্যান্সের সংশোধন প্রক্রিয়া এবং তার বাস্তবায়ন—সব কিছুই তাদের নজরে থাকবে। যদি সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তব পদক্ষেপ না নেয়, তবে আন্দোলন আরও বড় পরিসরে ফিরিয়ে আনার হুমকি রয়েছে। এখন সময় এসেছে প্রশাসনের ভিতরকার দুর্বলতা দূর করে, জনস্বার্থ রক্ষায় সাহসী ও ন্যায়ভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের।