পেট্রোল পাম্প মালিকদের ৮ ঘণ্টার ধর্মঘট:

পেট্রোল পাম্প ধর্মঘট

পেট্রোল পাম্প মালিকরা কমিশন বৃদ্ধি ও অন্যান্য দাবির প্রেক্ষিতে ৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে যান, যার ফলে দেশজুড়ে জ্বালানি সংকট ও জনদুর্ভোগ দেখা দেয়। প্রতিবাদ, প্রভাব এবং সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্লেষণ। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

ধর্মঘটের পেছনে জমে থাকা ক্ষোভ ও দাবির দীর্ঘ ইতিহাস

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে অন্যতম সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে তেল বিক্রিতে কমিশনের হার, প্রশাসনিক হয়রানি এবং নিয়মিত ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান। এসব কারণে পেট্রোল পাম্প মালিকরা দিনের পর দিন ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ করেন। তারা বলছেন, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যে পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে, তাতে বর্তমান কমিশন হারে লাভ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই তারা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন, কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না পাওয়ায় শেষমেশ তারা প্রতীকী ধর্মঘটের পথে হাঁটেন।

ধর্মঘটের মূল দাবি ও অভিযোগ: কমিশন বৃদ্ধির আহ্বান

পাম্প মালিকদের অন্যতম দাবি ছিল কমিশনের হার ২.৫% থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৭% করা, যাতে তেল বিক্রিতে টিকে থাকা যায়। এছাড়া, পরিবহন খরচ, ব্যাংক ঋণের সুদ, কর্মচারী বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ নানা খরচের ভার বহন করা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে। মালিকরা বলেন, জ্বালানি খাতে লাভের পরিবর্তে তারা এখন লোকসানে পড়ছেন। বিভিন্ন সংস্থার অযাচিত হস্তক্ষেপ, বারবার জরিমানা ও হুমকি মূলত তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তারা এটাও দাবি করেন যে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহ সচল রাখতে জ্বালানি খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ধর্মঘটের সরাসরি প্রভাব: জনসাধারণের দুর্ভোগ চরমে

সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৮ ঘণ্টার এই ধর্মঘট দেশের বহু এলাকায় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রাখে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শতাধিক পেট্রোল পাম্প বন্ধ থাকায় হাজারো মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ি জ্বালানি সংকটে পড়ে যায়। সাধারণ যাত্রীরা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তেল পাননি। গণপরিবহন চালকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেন, ফলে যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে বাধ্য হন। এছাড়া, বহু ব্যবসায়ী মালামাল পরিবহনে সমস্যায় পড়েন, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সরকারের অবস্থান: আলোচনার আশ্বাস ও প্রতিক্রিয়া

ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পাম্প মালিকদের দাবিগুলো পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে এবং একটি যৌক্তিক সমাধান খোঁজা হচ্ছে। তবে তারা ধর্মঘটের মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টিকে অনভিপ্রেত বলে উল্লেখ করেন। সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, তেল সরবরাহ একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়, এবং সেটিকে স্থায়ীভাবে সচল রাখতে হলে মালিকদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতেই হবে।

জ্বালানি সংকট বাংলাদেশ

ছবিঃ ঢাকা ট্রিবিউন

পরিকল্পিত ও একতাবদ্ধ আন্দোলন

বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ জ্বালানি পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃত্বে এই ধর্মঘট হয় অত্যন্ত সংগঠিতভাবে। পূর্বে ঘোষণা দিয়ে, পাম্প মালিকদের একত্র করে ধর্মঘটের কর্মসূচি পালন করা হয়। সংগঠনের নেতারা দাবি করেন, তারা সরকারের সঙ্গে বহুবার সংলাপে বসলেও কার্যকর প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায়, এই প্রতিবাদ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি দ্রুত সমাধান না আসে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, যা হতে পারে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট কিংবা বৃহত্তর জাতীয় কর্মসূচি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি খাতের এধরনের অচলাবস্থা দেশের উৎপাদন খাত, কৃষি, শিল্প এবং পরিবহন ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। প্রতিদিনকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জ্বালানি অপরিহার্য হওয়ায়, একদিনের ধর্মঘটেও বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সরাসরি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া জনমানুষের আস্থা হারিয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি মানুষের অসন্তোষ তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর

পাম্প মালিকরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তারা সাময়িকভাবে ৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে সীমাবদ্ধ থাকলেও, দাবি মানা না হলে পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দেবেন। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে। সংগঠনের নেতারা মনে করেন, কমিশন হার বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবি বাস্তবায়ন না হলে শুধু তেল সরবরাহ নয়, বরং দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

সমাধানে চাই আন্তরিক সংলাপ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা

এই ধর্মঘট আবারও প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত এক সংকটজনক ধাপ অতিক্রম করছে। কমিশন হার, পরিবহন খরচ ও প্রশাসনিক জটিলতা — এই সমস্যাগুলো সমাধান না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সরকারের উচিত হবে মালিকদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং একটি বাস্তবভিত্তিক, স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করা। জনগণের স্বার্থে ও দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এই পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *