বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূল প্লাবিত

বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের কারণে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে টানা ভারী বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। এতে প্লাবিত হয়েছে বহু এলাকা। জানুন বিস্তারিত প্রভাব, ক্ষয়ক্ষতি ও করণীয়। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ: দুর্যোগের ইঙ্গিত
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি নিম্নচাপ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নিম্নচাপটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং ক্রমেই এটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হচ্ছে। এই নিম্নচাপের ফলে ইতিমধ্যেই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে এবং তা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একাধিক জেলা জুড়ে তীব্র প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের উপকূলীয় জনগণের জন্য নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানুষের দুর্দশা চরমে
নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট অতিবৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর বহু এলাকা পানির নিচে চলে গেছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা ও কক্সবাজার জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার অনেক উপরে উঠে এসেছে। এতে করে চিংড়ি ঘের, কৃষিজমি, বসতঘর ও রাস্তাঘাটে হঠাৎ পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জলাবদ্ধতা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ আরও চরমে উঠেছে। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে দুর্ঘটনা এড়াতে।
সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ও সতর্ক সংকেত
আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা, বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপটি আরও শক্তিশালী হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এ প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে এবং গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতিনিয়ত নজরদারি চালাচ্ছে এবং এলাকাভিত্তিক আপডেট দিচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা থাকায় উপকূলীয় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিমকে সক্রিয় করেছে।
কৃষি ও মৎস্য খাতের উপর বিরূপ প্রভাব
বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের ফলে দেশের উপকূলীয় কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব কৃষক ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তারা পড়েছেন মারাত্মক বিপদে। জমির ধান পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অনেক জায়গায় চাষযোগ্য জমি প্লাবিত হওয়ায় আগাম মৌসুমের সবজি ও ফসল চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চিংড়ি ও সাদা মাছ চাষের ঘেরগুলো জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে গেছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কৃষি ও মৎস্য বিভাগ দ্রুতক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য কাজ শুরু করেছে বলে জানানো হয়েছে।
মানবিক সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
উপকূলবর্তী অঞ্চলে নিম্নচাপের কারণে দেখা দেওয়া বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে মারাত্মক মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায় বসবাস করছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। অনেক এলাকায় টয়লেট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি সংস্থাগুলো যৌথভাবে মেডিকেল টিম ও বিশুদ্ধ পানির সরঞ্জাম পাঠাতে শুরু করেছে, তবে ত্রাণ পৌঁছাতে এখনও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
পরিবেশগত ক্ষতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস
নিম্নচাপজনিত এই দুর্যোগ শুধু মানুষ বা অবকাঠামোর ক্ষতিই করছে না, বরং পরিবেশের উপরেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। জলোচ্ছ্বাসের ফলে লবণাক্ত পানি মিঠা পানির জলাশয়ে প্রবেশ করছে, যা জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। চিংড়ি ঘের ও মাছের খামার থেকে পোনা মাছ ভেসে গেছে এবং নদীর তীরবর্তী গাছপালার ক্ষতি হচ্ছে। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও এই নিম্নচাপের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এই ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাব ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে যদি তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়।