উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদীর পানি বৃদ্ধি, ব্যাপক বন্যার সতর্কতা জারি

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদনদীতে পানি বিপজ্জনকভাবে বাড়তে থাকায় সরকার ও প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। বন্যা ঝুঁকি, প্রস্তুতি এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
বড় নদীগুলোর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদনদীগুলোর পানি গত এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার মধ্যে সুরমা, কুশিয়ারা, ধরলা ও তিস্তা নদীর পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, এসব নদীর একাধিক পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বিশেষত সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবল বেগে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ফলে নদীর প্রবাহ বাড়ছে এবং আশপাশের নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে বন্যা সতর্কতা জারি করেছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আরও দুশ্চিন্তার বার্তা
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী ৩-৫ দিন পর্যন্ত সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর অঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। এ ধরনের আবহাওয়ায় উজানের পানি দ্রুত বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করবে, ফলে নদনদীর পানি আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা, যদি বর্ষা মৌসুমের এই বৃষ্টিপাতের ধারা অব্যাহত থাকে তবে জুনের শুরুতেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হতে পারে। এই আশঙ্কা মাথায় রেখে স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। জনগণকে সতর্ক বার্তা পাঠানোর জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে তারা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে।
কৃষি, ঘরবাড়ি ও জীবিকার উপর ঝুঁকি
বন্যার প্রাথমিক প্রভাবে ইতোমধ্যে অনেক নিচু এলাকার জমি পানির নিচে চলে গেছে। বিশেষ করে আমন ধানের বীজতলা, সবজির খেত এবং কিছু কিছু মাছের ঘের ভেসে গেছে বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে। এতে কৃষকদের মধ্যে তীব্র হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে অনেক কাঁচা ঘরে, যা সাধারণ মানুষের বসবাসের পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে স্থানান্তর শুরু করেছে। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা নিজেরাই মাটির বাঁধ ও কাঁচা ব্যারিকেড তৈরি করে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছেন। যদিও এই চেষ্টা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
স্থানীয় প্রশাসন প্রায় সব বন্যাপ্রবণ উপজেলায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে। সরকারিভাবে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ এবং স্যানিটেশন সামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সক্রিয় করতে শুরু করেছেন। এর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও নিজেদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছু এলাকায় নৌকা ও নৌকাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে সংকটময় মুহূর্তে মানুষকে উদ্ধার করা যায়। ফায়ার সার্ভিস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহায়তায় মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলমান আছে।

ছবিঃ ঢাকা ট্রিবিউন
যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের আশঙ্কা
বন্যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অনেক গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা ইতোমধ্যে পানির নিচে চলে গেছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলার কিছু রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পাকা রাস্তাগুলোর পাশের বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এসব এলাকায় যাতায়াত বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আগেভাগেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা মেরামত ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করছেন।
নদীভাঙন ও বসতবাড়ির বিপর্যয়
বন্যার কারণে নদীর পানি বাড়ার পাশাপাশি নদীভাঙনও তীব্রতর হয়েছে। বিশেষ করে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর দুই পাড়ে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইতোমধ্যে ভূমি ক্ষয় শুরু হয়েছে। অনেক পরিবার তাদের জমি, ঘরবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এই নদীভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ও বালুর বস্তা ফেলে নদীতীর রক্ষা করার চেষ্টা করছে। তবে বাঁধ দুর্বল হওয়ায় তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ রয়ে গেছে।
বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ ও চোখের সংক্রমণ ইতোমধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে। অনেক এলাকায় পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন উপজেলায় মেডিকেল টিম গঠন করেছে এবং প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে জরুরি ওষুধ পাঠানো হচ্ছে। তবে দুর্গম এলাকায় চিকিৎসা পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সংক্রমণ রোধে জনগণকে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সচেতনতা ও আগাম প্রস্তুতির গুরুত্ব
এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখন আসবে তা আমরা ঠেকাতে পারি না, কিন্তু সচেতনতা ও আগাম প্রস্তুতির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। নদী রক্ষা, বাঁধ নির্মাণ, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ এবং উন্নত আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রযুক্তি—সব মিলিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এই সংকটের মধ্যেও আমাদের উচিত একে অপরের পাশে দাঁড়ানো, দুর্যোগকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া।