বাংলাদেশের পর্যটন এলাকায় হোটেল সংকট: ভ্রমণ মৌসুমে বাড়ছে চাপ

ঈদ ও ছুটির মৌসুমে কক্সবাজার, সিলেট, বান্দরবানসহ জনপ্রিয় পর্যটন এলাকায় হোটেল বুকিং প্রায় সম্পূর্ণ। বাড়ছে ভ্রমণ খরচ ও আগাম রিজার্ভেশন চাহিদা। ছবিঃ সংগ্রহ
ঈদ ও ছুটির মৌসুমে পর্যটনের জোয়ার
বাংলাদেশে ঈদ কিংবা সরকারি ছুটির মৌসুম এলেই দেশের বিভিন্ন পর্যটনস্থানে মানুষের ঢল নামে। বিশেষ করে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সিলেট, বান্দরবান, রাঙামাটি ও সুন্দরবনের মতো জায়গাগুলোতে ভ্রমণপ্রেমীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। দেশের বিভিন্ন বড় শহর থেকে পরিবার, বন্ধু, কিংবা দম্পতিরা এই সুযোগে শহরের কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য দলে দলে ছুটছেন। এর ফলে পর্যটন এলাকার হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোর চাহিদা বেড়ে গিয়ে এখন প্রায় সব বুকিং পূর্ণ হয়ে গেছে।
দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত পর্যটন এলাকা
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা অন্যান্য স্থান থেকে বেশি থাকে। এখানকার পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ গেস্ট হাউস পর্যন্ত সব শ্রেণির আবাসনই এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে বুকড। স্থানীয় হোটেল মালিক সমিতির তথ্য মতে, ঈদ পরবর্তী সপ্তাহজুড়ে ৯০ শতাংশ হোটেল আগাম বুকিংয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। এমনকি কিছু পর্যটক জায়গা না পেয়ে বিকল্পভাবে চট্টগ্রামে রাত কাটাচ্ছেন এবং সেখান থেকে দিনে দিনে ঘুরে যাচ্ছেন কক্সবাজারে।
চা-বাগান, হাওর আর মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা সৌন্দর্যের কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জ হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য। হোটেল মালিকরা জানান, এই বছর শহরের প্রায় সব ভালো মানের হোটেল ও রিসোর্টগুলো ইতিমধ্যে বুকড হয়ে গেছে। জাফলং, রাতারগুল, বিছানাকান্দি ও তাহিরপুরে ভ্রমণকারীদের চাপ অনেক বেড়েছে। যারা আগাম বুকিং করতে পারেননি, তারা এখন খুঁজছেন স্থানীয় গেস্ট হাউস বা বাসভাড়াভিত্তিক আবাসন, যা অনেক সময় পর্যাপ্ত বা নিরাপদ নয়।
বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পাহাড়ের টানে
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অতুলনীয় ভান্ডার বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পাহাড়, ঝরনা আর ট্রেকিং রুটগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করছে বেশি। এখানেও পর্যটকদের ভিড়ের কারণে হোটেল মালিকরা অগ্রিম বুকিং নিয়েছেন ঈদের সপ্তাহখানিক আগেই। অনেক ট্রাভেল এজেন্সি জানাচ্ছে, তারা পর্যাপ্ত আবাসন না পেয়ে এখন পর্যটকদের জন্য বিকল্প এলাকা সাজিয়ে দিচ্ছে, যেমন নাফাখুমের বদলে চিম্বুক বা নীলগিরি এলাকায় স্বল্প সময়ের ট্রিপ সাজানো হচ্ছে।
হোটেলের দাম বাড়লেও ভ্রমণপ্রেমীরা আপস করছেন না
চাহিদা বৃদ্ধির ফলে হোটেলের রুমভাড়া ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। কিছু অভিজাত রিসোর্ট এক রাতের জন্য ৮,০০০–১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে, যা সাধারণ মৌসুমে অর্ধেক হতো। তারপরও ভ্রমণপ্রেমীদের উৎসাহ কমেনি। অনেকেই রুম শেয়ার করে থাকছেন কিংবা দূরের আবাসনে রাত কাটিয়ে মূল দর্শনীয় স্থানে দিনে দিনে ঘুরে আসছেন। এই প্রবণতা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, ভ্রমণের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখন কেবল বিলাস নয়, এটি হয়ে উঠেছে জীবনধারার অংশ।
হোটেল সংকটের সুযোগ নিচ্ছেন অনেক স্থানীয় বাসিন্দা। অনেকেই নিজেদের বাড়ি, গেস্ট হাউস কিংবা ফাঁকা ঘর পর্যটকদের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন। কিছু উদ্যোক্তা ঘরে তৈরি হোমস্টে ব্যবসা শুরু করেছেন, যেখানে পর্যটকরা স্থানীয় সংস্কৃতি উপভোগের পাশাপাশি নিরাপদে থাকতে পারছেন। এটি শুধু পর্যটকদের জন্যই নয়, স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও একটি বড় সুযোগ তৈরি করছে।
পর্যটন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দাবি
হোটেল বুকিংয়ের এই চাহিদা যেমন ভ্রমণপ্রেমীদের সমস্যায় ফেলছে, তেমনি পর্যটন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও তুলে ধরছে। দেশের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকায় এখন প্রয়োজন পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যাপ্ত আবাসন নির্মাণ ও পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হলে শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছেও বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।