বাংলাদেশে দুর্নীতি সর্বত্র বিস্তৃত: বিশেষ সহকারীর গভীর পর্যবেক্ষণ

দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। জানুন প্রশাসনিক ব্যর্থতা, জনগণের ভোগান্তি, ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

বাংলাদেশে দুর্নীতির সর্বব্যাপী প্রকৃতি

বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক ও সামাজিক বাস্তবতায় দুর্নীতি এমন এক দানবীয় রূপ ধারণ করেছে, যা জাতীয় অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, দেশের প্রায় প্রতিটি খাতে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু রাজধানী নয়, উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়েও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও অবৈধ লেনদেন একটি স্বাভাবিক চিত্র হয়ে উঠেছে। এই স্বীকারোক্তি সাধারণ মানুষের মনে যেমন হতাশা সৃষ্টি করেছে, তেমনি রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রশাসনিক কাঠামোয় দুর্নীতির অভ্যন্তরীণ বিস্তার

সরকারি দফতরে দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জনগণের দৈনন্দিন নাগরিক সেবা পাওয়া অনেক সময়ে হয়ে পড়ছে কঠিন ও ব্যয়বহুল। একটি সাধারণ কাগজপত্র ঠিক করতে গেলে দিনের পর দিন ঘুরতে হয় এবং ঘুষ না দিলে অনেক সময় কাজ হয় না। ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, কর অফিস, পুলিশ প্রশাসনসহ নানা বিভাগে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষকে যেন ‘অঘোষিত নিয়ম’ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। দুর্নীতি শুধু কাজের গতি কমাচ্ছে না, বরং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও নৈতিক ভিত্তিকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষা খাতে দুর্নীতির কুপ্রভাব

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে সরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এখন দুর্নীতির শিকার। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেন, ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি, পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস কিংবা ফলাফলে প্রভাব বিস্তার—এসব এখন যেন নিয়মিত ঘটনা। এর ফলে প্রকৃত মেধাবীরা যেমন সুযোগ হারাচ্ছে, তেমনি সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যখন দেখে যে যোগ্যতার চেয়ে টাকা ও প্রভাব বেশি কার্যকর, তখন তাদের মধ্যে হতাশা জন্ম নেয় এবং সমাজে একটি নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।

জনগণের জীবন নিয়ে ব্যবসা

সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন আজ ঝুঁকির মুখে। ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ চুরি, রোগীকে অযথা টেস্ট করানো, চিকিৎসকদের ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকা—এসব এখন একপ্রকার নিয়মিত অনিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেক সময় রোগীর জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব থাকা চিকিৎসক পর্যন্ত টাকা ছাড়া সেবা দিতে নারাজ। দালাল চক্র হাসপাতালের প্রতিটি স্তরে সক্রিয়, যারা রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে, অথচ সেবা মানে তেমন উন্নতি হয় না। স্বাস্থ্যসেবায় দুর্নীতির এই চিত্র দেশের মানবিক কাঠামোকেই কলুষিত করছে।

দুর্নীতি সমস্যা

ছবিঃ লিঙ্কেডিঙ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতির জটিলতা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতির বিস্তার সমাজে আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে। সাধারণ নাগরিকরা অনেক সময় পুলিশের কাছেই সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়। মামলা গ্রহণে ঘুষ, অভিযুক্তকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে লেনদেন, বা নিরীহ ব্যক্তিকে ফাঁসানো—এসব অভিযোগ এখন সাধারণ। জনগণের সুরক্ষার জন্য গঠিত বাহিনীগুলোর মধ্যে যখন এই অনিয়ম দেখা যায়, তখন অপরাধীরা উৎসাহিত হয় এবং নিরীহ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এটি সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সীমাবদ্ধতা

সরকার দুর্নীতি দমন করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করলেও, বাস্তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অনেক সময় দুর্নীতির বড় বড় অভিযোগের পরও সেগুলো তদন্তে ধীর গতি বা রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া মামলাগুলোর দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও প্রমাণ সংগ্রহে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্নীতিবাজরা শাস্তি এড়িয়ে যায়। বিশেষ সহকারীও ইঙ্গিত দেন যে, কাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা দুর্নীতিকে নির্মূল না করে বরং লালন-পালন করছে।

সামাজিক প্রতিরোধ ও নাগরিক সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়; এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষা প্রণয়ন, সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, ও মিডিয়ার শক্তিশালী ভূমিকা অপরিহার্য। আমরা যদি দুর্নীতিকে শুধু অপরের সমস্যা হিসেবে দেখি, তাহলে কখনই সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। বরং প্রত্যেককে নিজের অবস্থান থেকে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *