বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থা: জাতিগতভাবে শিক্ষার প্রতি আমাদের উদাসীনতা

বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জাতিগত উদাসীনতা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কতটা হুমকিস্বরূপ? এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে শিক্ষার প্রতি জাতিগত মনোভাব, এর কারণ, প্রভাব ও উত্তরণের উপায়। ছবিঃ টিটু দাস
জাতি হিসেবে শিক্ষার প্রতি আমাদের মনোযোগ কোথায়?
শিক্ষাকে একটি জাতির মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে এটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে দেখা যায়, শিক্ষা খাতকে আমরা প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেও কার্যত এটিকে সর্বনিম্ন অগ্রাধিকারে রাখা হয়। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত বাজেট বারবার কম থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে নেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এমনকি শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত, অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধার দিক থেকেও আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষা যেন একটি গৌণ বিষয়—এই মানসিকতা আমাদের ভবিষ্যৎকে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ও এর মূল কারণ
বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থা আজ বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অযোগ্য শিক্ষকের নিয়োগ, পাঠ্যপুস্তকে বিষয়বস্তুর দুর্বলতা, এবং পরীক্ষাভিত্তিক অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা। গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা এতটাই প্রকট যে শিক্ষার্থীদের শিখনপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, দায়িত্ববোধের ঘাটতি এবং তদারকির অভাব এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। শিক্ষার মানের পরিবর্তে এখন সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতিযোগিতাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার ফলে গড়ে উঠছে একটি অদক্ষ ও অপ্রস্তুত প্রজন্ম।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে শিক্ষা যেন এক প্রান্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষা নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও ক্ষমতায় আসার পর সেই প্রতিশ্রুতিগুলো অন্ধকারেই থেকে যায়। রাজনীতিবিদদের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ, যেগুলো দৃশ্যমান হলেও শিক্ষার মতো মৌলিক খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ চোখে পড়ে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী পরিকল্পনার আওতায় আনা জরুরি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের অভাব
শিক্ষাকে কেন্দ্র করে সমাজে যে মানসিকতা বিদ্যমান, তা অত্যন্ত দুর্বল ও একমুখী। এখনো অনেক পরিবারে শিশুর কাজ বা বিবাহকে প্রাধান্য দেওয়া হয় শিক্ষার চেয়ে। দরিদ্র পরিবারে সন্তানের পড়াশোনার বদলে আয় করার প্রতি জোর দেওয়া হয়। মেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এখনও গ্রামাঞ্চলে প্রবল। এমন একটি সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি না হওয়ায়, শিক্ষা খাত অনুন্নতই থেকে যাচ্ছে। সামাজিকভাবে শিক্ষাকে সম্মান ও অগ্রাধিকার না দিলে কোনো রাষ্ট্রই উন্নত হতে পারে না।
ডিজিটাল যুগে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থা
বর্তমানে যখন বিশ্ব শিক্ষা প্রযুক্তির দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো সেই গতির সাথে তাল মিলাতে পারছে না। কোভিড-১৯ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা নগ্ন করে দিয়েছে। অনলাইন শিক্ষা, ভার্চুয়াল ক্লাস, ডিজিটাল কনটেন্ট—এসব শব্দ শহরের গণ্ডির বাইরে এখনো অপরিচিত। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই ডিজিটাল সুবিধা, নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এই কারণে প্রান্তিক ও গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে সীমিত করে ফেলছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গুরুতর সমস্যা হলো শিক্ষার মানের চেয়ে সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতি অধিক মনোযোগ। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ কেবল পরীক্ষা পাস করার জন্য পড়াশোনা করছে, কিন্তু বাস্তবজ্ঞান বা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। ফলাফলস্বরূপ, আমাদের কর্মসংস্থানের বাজারে রয়েছে ডিগ্রিধারী কিন্তু দক্ষতাহীন কর্মশক্তি, যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করেও প্রাসঙ্গিক চাকরির যোগ্য নয়। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলবে।