বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কোটি মানুষ

ঢাকার বায়ু দূষণ পরিস্থিতি আবারও বিশ্বে শীর্ষে উঠে এসেছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে। অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে। ছবি: দয়নিক ইনকিলাব
বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার শীর্ষ স্থান অধিকার
ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ আবারও বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরেই ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাতাসে PM2.5 নামে পরিচিত ক্ষুদ্র ধূলিকণার মাত্রা নিরাপদ সীমার অনেক উপরে। এই ধূলিকণা এতটাই ক্ষতিকর যে তা সহজেই ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে নানা স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা প্রতিদিন এই অদৃশ্য বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন।
বায়ু দূষণের মূল উৎস কী কী?
পরিবেশবিদ ও গবেষকদের মতে, ঢাকার বায়ু দূষণের পেছনে একাধিক প্রধান কারণ কাজ করছে। শহরের যত্রতত্র চলাচল করা ধোঁয়াযুক্ত পুরনো যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি, নগরজুড়ে চলমান নির্মাণ প্রকল্প ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে সৃষ্টি হওয়া ধূলাবালিও বড় সমস্যা। রাজধানীর আশেপাশের অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা ও অনিয়ন্ত্রিত শিল্পকারখানা থেকেও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে দূষিত গ্যাস নির্গত হচ্ছে। এসব মিলিয়ে ঢাকার বায়ুমণ্ডল প্রতিনিয়ত বিষাক্ত হয়ে উঠছে, যার প্রভাব পড়ছে প্রতিটি নাগরিকের জীবনে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: নীরব ঘাতক হিসেবে বায়ু দূষণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণ এখন একটি ‘স্লো পয়জন’— যা প্রতিনিয়ত মানুষকে আক্রান্ত করছে অজান্তেই। দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, ক্যানসার এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগের ঝুঁকি। শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বয়স্ক এবং আগে থেকেই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এই দূষণ আরও বেশি মারাত্মক। গবেষণায় দেখা গেছে, দূষণপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিদের গড় আয়ু ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তবুও সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এখনো সীমিত।
সরকারের গৃহীত উদ্যোগ ও তার বাস্তব প্রভাব
সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বায়ু দূষণ রোধে নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কার্যকারিতা খুব সীমিত। সড়কে পুরনো যানবাহন বন্ধ করার কথা বলা হলেও তা এখনো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। নির্মাণস্থলে ধূলিকণা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দেখা যায় না, বরং নিয়ম ভেঙে চলছে অবাধ খোঁড়াখুঁড়ি। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করলেও তা ক্ষণস্থায়ী ও অপ্রতুল। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃত অর্থে ফল পেতে হলে দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই পরিকল্পনার পাশাপাশি সঠিক তদারকি প্রয়োজন।

ছবি: সময় টিভি
নাগরিকদের ভূমিকা ও করণীয়
সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও বায়ু দূষণ প্রতিরোধে সচেতন হওয়া জরুরি। দৈনন্দিন জীবনে কিছু পরিবর্তন এনে আমরা নিজেরা ও আমাদের পরিবারকে কিছুটা হলেও নিরাপদ রাখতে পারি। ঘরের বাইরে বের হলে উচ্চমানের N95 বা KN95 মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। নির্মাণ কাজের সময় আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখা ও পানি ছিটিয়ে ধুলো কমানো যায়। বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় গাছ লাগানো যেতে পারে, যা বাতাস শোধনে সহায়তা করে। শহরকে বাসযোগ্য রাখতে সবাইকে একযোগে সচেষ্ট হতে হবে।
এখনই সময় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার
ঢাকার বায়ু দূষণ কোনো সাময়িক সমস্যা নয়, এটি একটি চলমান সংকট যা প্রতিদিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম—সবকিছুই এই বিপদের সম্মুখীন। এখনই যদি শক্তিশালী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক, সংস্থা ও মিডিয়াকে এগিয়ে এসে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে। সচেতনতা, তদারকি ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি সবুজ ও স্বাস্থ্যকর ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব।