বিশ্বে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮৩ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে

যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিশ্বে ৮৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জানুন এই সংকটের পেছনের কারণ ও সমাধানের পথ। ছবিঃ এএফপি
বিশ্বজুড়ে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি: এক ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের নাম হলো অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি। জাতিসংঘের মতে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৮৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ নিজ দেশেই বাস্তুচ্যুত হয়ে রয়েছে, যা ইতিহাসে অন্যতম রেকর্ডসংখ্যক। এরা নিজ দেশের নাগরিক হয়েও নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে, অস্থায়ী বসতিতে বা জনবসতির বাইরের দুর্গম এলাকায় বাস করছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী শুধুমাত্র শারীরিক কষ্টে ভুগছে না, তারা সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কারণ পৃথিবীর নানা অঞ্চলে যুদ্ধ, রাজনৈতিক সহিংসতা, পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষ বাধ্য হচ্ছে নিজেদের বসতভিটা ছেড়ে পালাতে।
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির মূল কারণসমূহ
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, সশস্ত্র সংঘাত ও যুদ্ধ অন্যতম প্রধান কারণ। সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান, আফগানিস্তান, কঙ্গোর মতো দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ও সহিংস রাজনৈতিক সংঘর্ষ মানুষকে নিজের জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে শহরে বা অন্য কোনো স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা যেমন—বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস, খরা বা নদীভাঙন—এই বাস্তুচ্যুতির আরেক বড় উৎস। বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ এসব দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। তৃতীয়ত, জাতিগত দাঙ্গা ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন অনেক অঞ্চলে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে, যার ফলে পরিবারগুলো নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়।
বাস্তুচ্যুতদের জীবনযাত্রা ও প্রতিদিনের সংগ্রাম
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা তাদের আগের পরিচিত পরিবেশ, জীবনধারা ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা সাধারণত শরণার্থী শিবির বা জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়, যেখানে খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং শিক্ষা সবকিছুই সীমিত বা অনুপস্থিত। এসব শিবিরে জীবনের মান অত্যন্ত নিম্নমানের, যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। নারীরা যৌন সহিংসতা এবং শিশু ও কিশোররা পাচার ও শ্রমশোষণের শিকার হয়। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা ও মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ে। তাদের ভোটাধিকার, নাগরিক সেবা, এমনকি পরিচয়পত্র থেকেও বঞ্চিত করা হয়, যা তাদেরকে সমাজ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবিক সহায়তার সীমাবদ্ধতা
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) এবং বিভিন্ন এনজিও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের সহায়তায় কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বাস্তুচ্যুতদের জন্য আশ্রয়, চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা সরবরাহ করা হয় বটে, তবে তহবিল সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের কারণে বহু এলাকায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয় না। অনেক দেশ বাস্তুচ্যুতদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের আইনি সুরক্ষার বাইরে রাখে। ধনী রাষ্ট্রগুলো পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা না দিলে এই সংকট দীর্ঘমেয়াদে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

ছবিঃ জাপান টাইমস
জলবায়ু পরিবর্তন: ভবিষ্যতের আরও বড় বাস্তুচ্যুতি সৃষ্টিকারী
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী দশকে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বিপুল হারে বাড়তে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা ও অসম বৃষ্টিপাতের কারণে বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশে সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলগুলোর মানুষ ইতোমধ্যে পানির উত্থান ও কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। জলবায়ু শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও এখনো এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে যথাযথ আইনগত স্বীকৃতি ও সহায়তার অভাব রয়েছে। এই বাস্তবতা আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলায় এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের উপায় ও রাষ্ট্রীয় করণীয়
মানবিক সংকট রোধে শুধু ত্রাণ নয়, দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের উচিত বাস্তুচ্যুতদের জন্য স্থায়ী আবাসন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা নীতি গঠন করতে হবে। বাস্তুচ্যুতদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক পুনঃপ্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব বিবেকের জন্য আহ্বান
৮৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ ঘরহীন হয়ে নিজ ভূমিতেই উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। এরা কারও বাবা-মা, সন্তান, ভাই কিংবা বোন—এমন মানুষ যারা একসময় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন। এদের সমস্যা শুধু মানবিক নয়, এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও শান্তির জন্যও হুমকিস্বরূপ। তাই বিশ্ব বিবেকের উচিত এই সংকটকে গুরুত্বের সাথে দেখা এবং মানবতার স্বার্থে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এখনই সময় জাতিগত, রাজনৈতিক ও জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলায় একসাথে কাজ করার।