বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসে ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা

২০২৫ সালের বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
মামলার সংখ্যা বাড়ছেই: একটি ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর মামলা ও হয়রানির মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরে মোট ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। এই সংখ্যাটি শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি দেশের সাংবাদিকতার বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন। অধিকাংশ মামলা দায়ের হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানি ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে।
এসব মামলার কারণ হিসেবে সংবাদে ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সমালোচনা, দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ কিংবা সাধারণ নাগরিকের অধিকার তুলে ধরাকে সামনে আনা হচ্ছে। সাংবাদিকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ কেবলমাত্র সংবাদপত্র ও মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করার একটি রণনীতি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: স্বাধীন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় বাধা?
২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি মূলত সাইবার অপরাধ দমন এবং অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হলেও, বাস্তবে এটি সাংবাদিকদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্যমতে, এই আইনের অস্পষ্ট ধারাগুলোর মাধ্যমে সহজেই কাউকে অভিযুক্ত করা সম্ভব। ফলে, যে কোনো সময় সংবাদ প্রকাশের কারণে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার বা হয়রানির মুখে পড়তে হয়।
বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকরা জানান, অনেকে এখন ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’-এ বাধ্য হচ্ছেন—তারা আর নিরপেক্ষ বা বিতর্কিত ইস্যুতে লেখালেখি করতে সাহস পাচ্ছেন না। এতে সত্য উদঘাটনের কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
RSF-এর উদ্বেগ ও সুপারিশ
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF) প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ‘সংকটজনক’ বলে চিহ্নিত করেছে। RSF বলেছে, “২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, এটি স্পষ্টতই মিডিয়া দমন নীতির নির্দেশক।” তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর সুপারিশ রেখেছে।
RSF আরও উল্লেখ করেছে, মামলা ও আইনি চাপ সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং এতে করে প্রকৃত তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক সমাজে মেনে নেওয়া যায় না।

ছবি: বুসিনেস স্ট্যান্ডার্ড
সাংবাদিকদের ভয় ও বাস্তব অভিজ্ঞতা
সাংবাদিকরা বলছেন, প্রতিটি সংবাদ ফাইল করার সময় এখন তাদের ভয় কাজ করে—কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক মহলকে বিরক্ত করলে হয়তো আবার মামলা হবে বা জিজ্ঞাসাবাদে ডাকা হবে। অনেকেই জানান, পুলিশি হয়রানি, নজরদারি, ফোন ট্র্যাকিং এবং ফেক আইডি থেকে হুমকির বার্তা এখন ‘নিয়মিত ব্যাপার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন অভিজ্ঞ রিপোর্টার বলেন, “সাংবাদিকতা এখন শুধু পেশা নয়, যেন একপ্রকার বিপজ্জনক মিশনে পরিণত হয়েছে। আমরা তথ্য সংগ্রহের আগে ভাবি—তথ্য প্রকাশ করবো কি না।”
সরকারের বক্তব্য: বিচার বিভাগ স্বাধীন, তবে দায় এড়ানো যাবে না
সরকার দাবি করছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হয় এবং সরকার এতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। তথ্যমন্ত্রী বলেন, “সরকার মিডিয়া-বান্ধব এবং প্রেসের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।” তবে বাস্তবতা ভিন্ন ছবি উপস্থাপন করছে। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে যে প্রশাসনের নীরব সম্মতি ও কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এত মামলা দায়ের হওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এই নির্লিপ্ত আচরণ আসলে দায় এড়ানোর কৌশল। গণতন্ত্রে শুধুমাত্র বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়—প্রশাসনের সদিচ্ছাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর দমন-পীড়নের এই ধারা আন্তর্জাতিক মহলেও নজরে এসেছে। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক সংস্থা এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, গণমাধ্যম স্বাধীনতা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার।
এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে যে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
এখনই সময় গণমাধ্যমের পাশে দাঁড়ানোর
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই মামলার প্রবণতা কেবল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য নয়, গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও একটি হুমকি। তথ্য জানার অধিকার জনগণের মৌলিক অধিকার, আর সেই অধিকার নিশ্চিত করে সাংবাদিকেরা। সাংবাদিকতা যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরেই ন্যায়বিচার দুর্বল হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, বিচার বিভাগ, সংবাদপত্র মালিক, সাধারণ জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। এখনই সময় গণমাধ্যমের পাশে দাঁড়ানোর।