ভারত-পাকিস্তানের ড্রোন যুদ্ধ: এশিয়ায় প্রযুক্তিনির্ভর নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা

ভারত পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান ড্রোন প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলছে। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুদ্ধ পরিণত হয়েছে নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতায়। ছবিঃ ডেইলি ষ্টার

ড্রোন যুদ্ধের সূচনা ও বর্তমান পরিস্থিতি

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ দিনের বৈরিতা বিভিন্ন সময়ে নানা রূপ নিয়েছে—কখনও সরাসরি যুদ্ধ, কখনও সীমান্তে গোলাগুলি, আবার কখনও কূটনৈতিক চাপ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই উত্তেজনা প্রযুক্তির নতুন স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে দুই দেশই ড্রোন প্রযুক্তিকে তাদের সামরিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে ২০২৩ সাল থেকে সীমান্ত অঞ্চলে ড্রোনের আনাগোনা এবং ভূপাতিত করার ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান ও জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তান থেকে নিয়মিতভাবে ড্রোন প্রবেশের অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে পাকিস্তান বলছে, ভারতীয় ড্রোন তাদের সামরিক স্থাপনার ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক গভীর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারিক দিক

ড্রোন প্রযুক্তি প্রথমে ব্যবহৃত হয় নজরদারির কাজে, তবে বর্তমানে এটি সশস্ত্র আক্রমণ চালানোর জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারত বর্তমানে ইসরায়েলি ‘হেরন’ ড্রোন এবং দেশীয়ভাবে তৈরি ‘রুস্তম’ ড্রোন ব্যবহার করছে, যা দীর্ঘক্ষণ উড়তে পারে ও দূর থেকে টার্গেট পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। ভারতীয় সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই এই ড্রোনগুলো সীমান্ত পাহারার কাজে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান চীনের সহায়তায় ‘উইং লুং’ ও ‘শাহপার’ সিরিজের ড্রোন পরিচালনা করছে, যেগুলো আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা রাখে। উল্লেখযোগ্যভাবে, উভয় দেশই এখন ড্রোনে AI প্রযুক্তি সংযোজনের দিকে ঝুঁকছে, যা ভবিষ্যতে যুদ্ধের রূপ আমূল বদলে দিতে পারে।

সীমান্ত পরিস্থিতি ও উসকানিমূলক কার্যকলাপ

সীমান্ত অঞ্চলে ড্রোন কার্যক্রম শুধু নজরদারি নয়, মাঝে মধ্যেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও মাদক পাচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কয়েকবার দাবি করেছে যে পাকিস্তান থেকে পাঠানো ড্রোনের মাধ্যমে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদকদ্রব্য পাচারের চেষ্টা হয়েছে। এই ধরনের কার্যকলাপ সীমান্তে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তান আবার বলছে যে ভারতীয় ড্রোন তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য সংগ্রহ করছে। এই অবিশ্বাস ও পারস্পরিক দোষারোপের ফলে দুই দেশের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ঘটনাও বড় সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

ভারত ও পাকিস্তানের এই ড্রোন প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং জাতিসংঘ এই পরিস্থিতির ওপর গভীর নজর রাখছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এই ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিযোগিতা অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষের সম্ভাবনা তৈরি করছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও দুই দেশকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট দেশ যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশও এই অবস্থার প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

 সামরিক ড্রোন প্রযুক্তি

ছবিঃ রেউটার্স

সামরিক কৌশল ও নতুন ড্রোন প্রযুক্তির সমীকরণ

ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই ড্রোন যুদ্ধকে সামরিক কৌশলে কেন্দ্রীয় অবস্থান দিচ্ছে। ভারত বর্তমানে ‘সোয়ার্ম ড্রোন’ প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছে, যেখানে বহু ড্রোন একসঙ্গে আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে। পাকিস্তানও চীনের সহায়তায় এই ধরনের কৌশলগত ড্রোন ইউনিট গঠন করছে। সেনাবাহিনীর মহড়ায় এই ড্রোনগুলোর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ম্যানড ড্রোনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধ ড্রোন ব্যবহারের পরিকল্পনা দুই দেশেরই রয়েছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়মই বদলে দিতে পারে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক প্রতিবন্ধকতা

এই ড্রোন যুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। ভারতের সরকার ড্রোন অনুপ্রবেশকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করছে এবং প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও ভারতকে ‘আক্রমণাত্মক নজরদারি’ চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই রাজনৈতিক উত্তেজনা কূটনৈতিক সমাধানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা স্থগিত রয়েছে এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতাও বিশেষ অগ্রগতি দেখাতে পারছে না।

জনমত ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

দুই দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যেও এই ড্রোন যুদ্ধ নিয়ে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। একদিকে জাতীয় গৌরব এবং সামরিক শক্তির প্রতি সমর্থন, অন্যদিকে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের আশঙ্কায় উদ্বেগ—দুটিই একইসঙ্গে প্রবলভাবে কাজ করছে। ভারতের নাগরিকরা সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধির পক্ষে মত দিচ্ছেন, আবার পাকিস্তানেও অনেকেই সরকারের অবস্থান সমর্থন করছেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ড্রোন যুদ্ধকে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা হিসেবে দেখছেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *