ভুয়া ঘোষণার শাস্তি কমালে বাড়বে চোরাচালান: বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

আমদানি রপ্তানি আইন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া ঘোষণার শাস্তি কমালে দেশে চোরাচালান আরও বাড়বে। এতে রাজস্ব, ব্যবসায় পরিবেশ ও নিরাপত্তায় পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। বিস্তারিত জানুন এই প্রতিবেদন থেকে। ছবিঃ ডেইলি স্টার

ভুয়া ঘোষণা ইস্যুতে শাস্তি কমানোর উদ্যোগ

সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় দেওয়া ভুয়া ঘোষণার শাস্তি কমানো সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সামনে আসায় বাণিজ্য ও রাজস্ব বিশ্লেষকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে চোরাচালানকারীদের জন্য নতুন এক সুযোগ তৈরি হবে, যা দেশের বৈধ অর্থনীতি এবং রাজস্ব আহরণকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। শাস্তি হ্রাস করার যুক্তি হিসেবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমানোর কথা বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা একে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন।

চোরাচালান উৎসাহিত করার সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুয়া ঘোষণা ও চোরাচালান একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যখন কোন ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে আমদানিকৃত পণ্যের প্রকৃত বিবরণ গোপন করে, তখন তা সরাসরি চোরাচালান হিসেবে বিবেচিত হয়। যদি এই ধরনের অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি না থাকে কিংবা শাস্তির মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে আরও বড় আকারে চোরাচালান পরিচালনা করবে। এর ফলে বৈধ বাণিজ্যপ্রক্রিয়ায় থাকা ব্যবসায়ীদেরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব

ভুয়া ঘোষণা এবং চোরাচালানের কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায় সরকার। সংশ্লিষ্টদের মতে, কাস্টমস ও এনবিআর প্রতিনিয়ত পণ্যের মূল্য, পরিমাণ ও বিবরণ সংক্রান্ত অসংখ্য ভুয়া ঘোষণা শনাক্ত করে থাকে। যদি এই ধরনের অপরাধে শাস্তি হ্রাস পায়, তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়বে এবং রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এতে করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দও চাপের মুখে পড়বে।ভুয়া ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া অসাধু ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম দামে পণ্য বাজারজাত করতে পারে, যা সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় যদি শাস্তির ভয় না থাকে, তাহলে সৎ ব্যবসায়ীরাও অনৈতিক পন্থায় ঝুঁকতে পারে, ফলে পুরো বাজার ব্যবস্থাই বিঘ্নিত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ তখনই স্থিতিশীল হয়, যখন আইনের শাসন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর থাকে।

নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা

ভুয়া ঘোষণার আড়ালে শুধু পণ্য নয়, অস্ত্র, মাদক, এমনকি মানব পাচারও সংঘটিত হতে পারে। যদি এই অপরাধে শাস্তি লঘু করা হয়, তাহলে জাতীয় নিরাপত্তাও চরম হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষ করে বন্দরে কমসংখ্যক কাস্টমস অফিসার এবং পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সহায়তা না থাকলে এমন ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এই প্রসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রও এই দুর্বলতা কাজে লাগাতে পারে।

বিশ্ব বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে হলে স্বচ্ছতা ও নিয়মানুবর্তিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি বাংলাদেশে ভুয়া ঘোষণাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় বা শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে এবং আমদানি-রপ্তানি চুক্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

প্রযুক্তি ও আইনের কার্যকর প্রয়োগ জরুরি

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ, শাস্তি হ্রাস না করে বরং প্রযুক্তি-নির্ভর তদারকি, স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ঘোষণা যাচাইয়ের ব্যবস্থা আরও জোরদার করা উচিত। একই সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও আইন প্রয়োগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি, সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য অনলাইন ফাস্ট ট্র্যাক চ্যানেল চালু করে হয়রানি কমানোর পাশাপাশি শাস্তির কড়াকড়ি বজায় রাখা উচিত।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভুয়া ঘোষণা ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে। ব্যবসা বান্ধব নীতির নামে যদি অপরাধের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে সৎ ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হন এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান বজায় থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *